ট্রাম্পের ইরান আক্রমণ: ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ঝুঁকিপূর্ণ দাও

২৩ জুন ২০২৫ - ০৯:১৩ পূর্বাহ্ণ
 0
ট্রাম্পের ইরান আক্রমণ: ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ঝুঁকিপূর্ণ দাও

ইরানের গোপন পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলোতে সরাসরি হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সাহসী ও উচ্চঝুঁকিপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করেছেন। বহু বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রশাসনের জন্য ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ছিল একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণ। এবার এই হামলার প্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করবে ট্রাম্প প্রশাসনের আন্তর্জাতিক অবস্থান এবং তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।যদি ইরান এই আঘাতের পর উল্লেখযোগ্য কোনো পাল্টা জবাব না দিতে পারে, তবে ট্রাম্প তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক ও সামরিক সুবিধা অর্জন করবেন। একদিকে চিরশত্রুর শক্তি খর্ব করা হবে, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া ও অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিকে তাঁর নির্ভীক নেতৃত্বের বার্তা পৌঁছে যাবে। কিন্তু যদি ইরান প্রতিশোধে নামে বা মার্কিন শর্তে কোনো চুক্তিতে রাজি না হয়, তাহলে এই আক্রমণ দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের সূচনা করতে পারে—যা অনেক রিপাবলিকান সমর্থকের মধ্যেই অসন্তোষ সৃষ্টি করছে।

ট্রাম্প তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেছিলেন ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতার মাধ্যমে। সে সময় তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে যুদ্ধবাজি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহারের জন্য কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। অথচ সেই ট্রাম্পই এখন সম্পূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটলেন।

গত রোববার, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পাহাড়ঘেরা অঞ্চলের ভেতরে লুকানো পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে স্টিলথ বোমারু বিমানের সাহায্যে শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপ করে। হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে ট্রাম্প এই অভিযানের প্রশংসা করে বলেন, “ইরানের প্রধান পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রসমূহ সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে।”তিনি আরও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “আমরা শান্তি চাই, কিন্তু তা যদি না আসে, তাহলে ইরানের জন্য আরও বড় বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।” তাঁর ভাষায়, “আরও অনেক লক্ষ্য নির্ধারিত আছে, এবং আমরা দ্রুত ও নির্ভুলভাবে সেগুলোতেও হামলা করব।”

তবে বাস্তবতা হলো, ইরানের জনসংখ্যা ইরাকের প্রায় দ্বিগুণ এবং দেশটির আঞ্চলিক প্রভাব অনেক বিস্তৃত। একাধিক যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের রয়েছে অভিজ্ঞতা। যদি ইরান মার্কিন সেনা বা নাগরিকদের ওপর পাল্টা হামলা চালায়, তাহলে এই সংঘাত দ্রুতই আন্তর্জাতিক রূপ নিতে পারে।পূর্ববর্তী কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। ডেমোক্র্যাট সিনেটর ও সশস্ত্র বাহিনী বিষয়ক কমিটির শীর্ষ সদস্য জ্যাক রিড মন্তব্য করেন, “ট্রাম্প এক বড় ধরনের রাজনৈতিক জুয়া খেলেছেন, যার ফল অনিশ্চিত।”

প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অতীতে একই ধরনের পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক সমাধানকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তবে তখনকার তুলনায় এখন ইরান বেশি সংকটে রয়েছে। সিরিয়া, লেবানন ও গাজার মিত্রগোষ্ঠীগুলোর পতনে তাদের আঞ্চলিক শক্তি অনেকটাই ক্ষয় হয়েছে। ট্রাম্প বলেন, এই সামরিক পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের শর্তে একটি নতুন চুক্তিতে সম্মত করা।

কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, বলপ্রয়োগ করে ইরানকে চুক্তিতে আনাটা খুব একটা সহজ হবে না। ডিফেন্স প্রায়োরিটিজ থিংক ট্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পরিচালক রোজমেরি কেলানিক বলেন, “এই পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি শাসন পরিবর্তন যুদ্ধের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিল।”মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, ইরান এখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি শুরু করেনি, কিন্তু এই হামলা তাদের সেই পথেই ঠেলে দিতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক হস্তক্ষেপবিরোধী মনোভাবই ট্রাম্পকে একসময় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। তাঁর ২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রতিপক্ষ হিলারি ক্লিনটন ইরাক যুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন—সেই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান ছিল জনসমর্থনের বড় কারণ। অথচ এবার তিনিই সরাসরি সংঘাতে জড়াচ্ছেন, যা তাঁর নিজের অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

চলতি বসন্তে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে তাঁর ঘনিষ্ঠ প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফকে ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তি করার চেষ্টা করতে পাঠানো হয়েছিল। এতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চাপে পড়েছিলেন। হোয়াইট হাউস সূত্র জানায়, ইসরায়েলকে আগাম হামলার বিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু ফোনে আলোচনা করেন, যেখানে ট্রাম্প বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এখন একটি ঐক্যবদ্ধ দল।” নেতানিয়াহু প্রতিক্রিয়ায় জানান, “আজ ইতিহাস ঘুরে গেল। এ নেতৃত্ব মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ উন্মোচন করবে।”

তবে অনেক ট্রাম্পপন্থী এই হামলা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছেন। ডানপন্থী প্রভাবশালী নেতা স্টিফেন ব্যানন ও চার্লি কার্ক ট্রাম্পকে আগে থেকেই যুদ্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁরা সরাসরি আক্রমণের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘অনেক মাগা (Make America Great Again) সমর্থক এখন খুশি নন।’ কার্ক বলেন, “ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত অতীতে কার্যকর হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কি পুরো ধ্বংস হয়েছে, আমরা নিশ্চিত না। বরং পাল্টা হামলায় কত মার্কিন প্রাণ যাবে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।”অনেক তরুণ সমর্থক এখন প্রশ্ন তুলছেন, “আমাদের নিজেদের সমস্যা না মিটিয়ে কেন অন্যদের নিয়ে যুদ্ধ?”ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই শান্তি ও শক্তি প্রদর্শনের দ্বন্দ্বে ছিলেন। তাঁর শান্তি পুরস্কারের ইচ্ছা সুপরিচিত হলেও এবার তিনি সরাসরি সামরিক শক্তির পথ বেছে নিয়েছেন। যে প্রতিশ্রুতি তাঁকে ক্ষমতায় এনেছিল, আজ তার বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে তিনি।