২৫ বছরে ৯১টি বাঘের মৃত্যু, হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ

২৯ জুলাই ২০২৫ - ০৮:১০ পূর্বাহ্ণ
 0
২৫ বছরে ৯১টি বাঘের মৃত্যু, হুমকির মুখে সুন্দরবনের বাঘ

গর্জনের সাহসে পৃথিবী কাঁপানো সুন্দরবনের বাঘ আজ টিকে থাকার লড়াইয়ে। গত ২৫ বছরে (২০০১–২০২৫) সুন্দরবনে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৯১টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এর মধ্যে ৫৮টি বাঘ পিটিয়ে বা শিকার করে হত্যা করা হয়েছে, ৩০টি বাঘ স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে এবং ৩টি প্রাণ হারিয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে। ভয়াবহ এই চিত্রই সামনে এসেছে বিশ্ব বাঘ দিবস (২৯ জুলাই) উপলক্ষে।

সুন্দরবন বিভাগের বন সংরক্ষক (খুলনা অঞ্চল) ইমরান আহমেদ জানান, ‘বিগত ২৫ বছরে ৯১টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। তবে আশার কথা, গত ১০ বছরে শিকার ও হত্যার ঘটনা অনেক কমে এসেছে। বাঘ রক্ষায় নেয়া প্রকল্প ও মনিটরিং ব্যবস্থা ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।’

তবে বাস্তবতা বলছে- নোনা পানি, জলবায়ু পরিবর্তন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, শিল্পকারখানার দূষণ এবং বনের ভেতর দিয়ে চলাচলরত নৌযানের আওয়াজে বাঘের বসবাস ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে।

বাঘ সংরক্ষণে সরকার ‘সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প’ এবং ‘সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প’ চালু করেছে। এই প্রকল্পে ৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। চলছে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, সংক্রমণ ব্যাধি শনাক্তকরণ ও হরিণ শিকারের ঝুঁকিপূর্ণ ২৫টি স্থান চিহ্নিতকরণ।

ইমরান আহমেদ আরও বলেন, ‘বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলোতে দড়ি বেষ্টনী দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাঘের আবাসস্থল সুরক্ষায় মনিটরিং আরও জোরদার করা হয়েছে।’

এদিকে সুন্দরবনসংলগ্ন শিল্প-কারখানার দূষণ, বনের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের শব্দ ও বর্জ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবসহ নানা কারণে বাঘের আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে পড়ছে। ২০২৪ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে পরিচালিত বাঘ গণনায় বন বিভাগ সংখ্যা বাড়ার আভাস দিলেও, পরিবেশবিদরা সতর্ক করে বলছেন- সুন্দরবনে বাঘের টিকে থাকা এখনও মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বাগেরহাট শাখার আহ্বায়ক নুর আলম শেখ বলেন, ‘বাঘ শিকার যেমন একটি হুমকি, তেমনি বিষ দিয়ে মাছ ধরার ফলে বিষাক্ত পানি পান করে অনেক বাঘ মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি হরিণের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে।’

‘সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘শুধু জরিপ বা প্রকল্প দিয়ে হবে না, পুরো ইকোসিস্টেম রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। বাঘের খাদ্য হরিণ ও বুনো শুকরের সংখ্যা বাড়াতে হবে, নিরাপদ প্রজননের ব্যবস্থা ও আপৎকালীন আশ্রয়স্থল গড়ে তুলতে হবে।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলে ওঠা সম্ভব হলেও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ সবচেয়ে ভয়ানক। শিল্পকারখানার দূষণ, বিষাক্ত বর্জ্য, নৌযানের শব্দ-এসবই বাঘের আবাস ধ্বংস করছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বন ধ্বংস মানেই নিজেদের ধ্বংস। সুন্দরবনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার তথ্যমতে, ২০১০ সালে পরিচালিত এক জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪০০ বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ ও ২০১৮ সালে দুটি পৃথক গণনায় বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০৬-এ। সবশেষ ২০২৩ সালে বন বিভাগের করা ক্যামেরা ট্র্যাপিং জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি বলে জানানো হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংখ্যায় কিছুটা বাড়তির দিকে দেখা গেলেও টিকে থাকার পরিবেশ এখনো অনিরাপদ। ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের ফলাফলে নতুন শাবকের অস্তিত্ব মিললেও দীর্ঘমেয়াদে বাঘ সংরক্ষণের জন্য মানবসৃষ্ট হস্তক্ষেপ কমানো না গেলে সুন্দরবনে বাঘের রাজত্ব আর বেশিদিন টিকবে না।

বাঘ তার হিংস্র গতি, দুর্দমনীয় শক্তি ও অনন্য সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত। বিশ্বজুড়ে বাঘের মোট ৯টি উপ-প্রজাতি থাকলেও, গত শতাব্দীতে এর মধ্যে ৩টি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী এই শীর্ষ স্তরের প্রাণী এখন নানা হুমকির মুখে রয়েছে তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে।