প্রাথমিক হিসাবে ফেনীতেই বন্যায় ক্ষতি ১৪৬ কোটি টাকা, চূড়ান্ত হিসাবে আরও বাড়বে

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সৃষ্ট বন্যায় ফেনী জেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষক, মাছচাষি ও গবাদিপশু পালনকারীরা। জেলায় বন্যার পানি কমে যাওয়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে এই দুর্যোগের ক্ষতচিহ্ন।
টানা বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে ৮ জুলাই থেকে ফেনী জেলায় শুরু হয় ভয়াবহ বন্যা। জেলার প্রধান তিন নদী-মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে হু-হু করে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে, প্লাবিত হয় জেলার পাঁচ উপজেলার ১৩৭টি গ্রাম। এরপর ১০ জুলাই থেকে বৃষ্টিপাত কমে আসায় পানি নামতে শুরু করে। এতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে দুর্যোগের ক্ষতচিহ্ন।
বন্যার ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞা উপজেলা। এর মধ্যে পরশুরাম, ফেনী সদর ও দাগনভূঞায় কিছুটা পানি নেমে গেলেও ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়ার পাঁচটি গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন।

ফেনীর বন্যা। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এই পাঁচ গ্রামের ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্রে গতকাল সোমবার রাত পর্যন্ত অবস্থান করছিলেন ৩৩০ জন বানভাসি মানুষ। অনেকেই এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে নিজেদের বাড়ির উঁচু জায়গায় কিংবা বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সরকারি পাঁচটি দপ্তরের প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণে ফেনীর সাম্প্রতিক বন্যায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
সড়ক ও অবকাঠামো খাত: টানা বর্ষণ ও নদীর পানি উপচে পড়ায় গ্রামীণ সড়কগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশ কিছু স্থানে ৫-৬ ফুট পানির তোড়ে রাস্তা ভেঙে গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯০ কোটি টাকা।
কৃষি খাত: ডুবে গেছে বিপুল পরিমাণ আউশ, আমনের বীজতলা এবং শাকসবজির জমি। এতে ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ কোটি ৭ লাখ টাকা।
মৎস্য খাত: পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে যাওয়ায় মাছচাষিরা বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
প্রাণিসম্পদ খাত: গবাদিপশু হারানো, খাদ্যের সংকট ও খামারঘর ধ্বংসের ফলে ক্ষতির পরিমাণ ৬৫ লাখ টাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাঁধ ভাঙন): মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে পড়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৯ কোটি টাকা।

পুকুর ও মাছের ঘের ভেসে যাওয়ায় মাছচাষিরা বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় জেলার প্রধান তিন নদী-মুহুরী, কুহুয়া ও সিলোনিয়া-নদীর মোট ৪১টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এর মধ্যে পরশুরাম উপজেলায় ২২টি এবং ফুলগাজীতে ১৯টি ভাঙনস্থল শনাক্ত করা হয়েছে।
ফেনী ও আশেপাশের এলাকাবাসী জানিয়েছেন, বন্যার পানি জমির বীজতলা তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পাশাপাশি পুকুর, দিঘি ও মৎস্য খামারের পানির তোড়ে মাছ ভেসে যাওয়ায় মৎস্যজীবীরাও বড় ধরনের আর্থিক দুর্ভোগে পড়েছেন। প্রতিবছর এই মৌসুমে বন্যা হয়, আর আমরা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ফসল ও মাছসহ অন্য আয় উপার্জনের সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তারা দ্রুত ক্ষতি পূরণ ও পুনর্বাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ও টেকসই সহায়তা দাবি করেছেন।
ফেনীর স্থানীয় সরকার বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহমুদ আল ফারুক বলেন, ‘বন্যার সময় কোনো কোনো সড়কের ওপর দিয়ে ৫ থেকে ৬ ফুট পানি প্রবাহিত হওয়ায় রাস্তার বড় অংশ বিলীন হয়েছে। অনেক স্থানে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, যা দ্রুত মেরামত না করলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’

এখনো পানিবন্দী অনেক মানুষ। ফেনীতে বন্যাপরবর্তী পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে বলে জানিয়েছেন ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ইসমাইল হোসেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জেলায় বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। বিভিন্ন এলাকায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে এখনো অনেক মানুষ কষ্টে রয়েছেন, তাই ত্রাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তিনি আরও জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কাছে নতুন করে ৩০ লাখ টাকা ও ৫০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকায় ১১ হাজার ১৭৪ জন বন্যাদুর্গত মানুষকে ত্রাণসামগ্রী প্রদান করা হয়েছে। ত্রাণের মধ্যে রয়েছে শুকনো খাবার, চাল, বিশুদ্ধ পানি ও প্রাথমিক চিকিৎসা সহায়তা।
ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ‘বন্যা পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। বিভিন্ন দপ্তর প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিয়েছে, তবে এটি চূড়ান্ত নয়। পানি পুরোপুরি নামার পর সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে। তখনই পূর্ণাঙ্গভাবে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নির্ধারণ করে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হবে।

বাঁধ ভেঙে সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ফেনী থেকে নেমে আসা ঢলের পানি ও টানা বৃষ্টির ফলে নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচর, বেগমগঞ্জ, সেনবাগ ও চাটখিলসহ কয়েকটি উপজেলায় সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা। এতে আউশ ও আমনের বীজতলা এবং বিভিন্ন মৌসুমি শাক-সবজি চাষের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত বিবরণ পাওয়া যায়নি। পানি নেমে গেলে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানা যাবে।
প্রসঙ্গত, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও ফেনীর দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, জলাবদ্ধতা এবং পানি নিষ্কাশনের অব্যবস্থার প্রতিবাদে ঢাকায় একটি মানববন্ধন ও প্রতীকী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার (১৩ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়, রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এই কর্মসূচি পালন করা হয়।
ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার শিক্ষার্থীদের তিনটি সংগঠন- নোয়াখালী ছাত্রকল্যাণ পরিষদ, লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রকল্যাণ পরিষদ এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অব ফেনী-এর যৌথ উদ্যোগে এই প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

স্থানীয় ব্যক্তি। কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা দীর্ঘদিন ধরে চলমান বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে তাদের এলাকায় যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে, তার স্থায়ী সমাধান দাবি করেন। তারা অবিলম্বে কার্যকর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য প্রশাসনের প্রতি জোরালো আহ্বান জানান।