আশুরার ফজিলত ও কারবালার চিরন্তন বার্তা

৪ জুলাই ২০২৫ - ১৩:৫৯ অপরাহ্ণ
 0
আশুরার ফজিলত ও কারবালার চিরন্তন বার্তা

ইসলামি বর্ষপঞ্জির সূচনায় আগত মাস মহররম, যা শুধু একটি হিজরি মাস নয়—বরং তা বহু ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক। এই পবিত্র মাসের ১০ তারিখ, যা ‘আশুরা’ নামে সুপরিচিত, মুসলিম জাতির ইতিহাসে একইসঙ্গে রাহমাত, বারাকাত ও ত্যাগের এক গৌরবময় প্রতীক।

আরবি শব্দ ‘আশারা’ অর্থ ‘দশ’। সেই সূত্রেই মহররমের দশম দিনটিকে আশুরা বলা হয়। এই দিনটিকে ঘিরে রয়েছে নবী-রাসুলদের জীবনে সংঘটিত একাধিক অলৌকিক ঘটনা ও পরীক্ষার গাঁথা, যা এ দিনটির মর্যাদা ও গুরুত্ব বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইসলামি বর্ণনায় এসেছে, এই দিনেই আল্লাহ তাআলা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন, হজরত নুহ (আ.)-এর কিস্তি জুদি পর্বতে অবতরণ করে, হজরত ইব্রাহিম (আ.) আগুন থেকে রক্ষা পান, হজরত ইউনুস (আ.) মুক্তি পান মাছের পেট থেকে এবং হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন। একই দিনে হজরত সুলাইমান (আ.) রাজত্ব ফিরে পান, হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। এমনকি হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর প্রিয় সন্তান ইউসুফ (আ.)-এর পুনর্মিলনও এ দিনেই উপভোগ করেন।

এই দিন রোজা রাখার গুরুত্ব ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই বিদ্যমান। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা অবস্থানকালেই আশুরার রোজা রাখতেন এবং সে সময় এটি ফরজও ছিল। পরবর্তীতে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল হিসেবে অবশিষ্ট থাকে, তবে তা অতীব ফজিলতপূর্ণ। সহিহ হাদিসে বর্ণিত, “আশুরার রোজা আগের বছরের গুনাহ মাফ করিয়ে দেয়।” (মুসলিম, আহমাদ)

মদিনায় হিজরতের পর নবী করিম (সা.) লক্ষ্য করেন, ইহুদি সম্প্রদায় আশুরায় রোজা রাখে, কারণ এই দিন ফেরাউনের হাত থেকে হজরত মুসা (আ.)-এর মুক্তি লাভ হয়। তখন রাসুল (সা.) মুসলমানদের আশুরার সঙ্গে একদিন আগে বা পরে মিলিয়ে দুই দিন রোজা রাখার নির্দেশ দেন, যাতে মুসলিম উম্মাহ আলাদা বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “আমি যদি আগামী বছর জীবিত থাকি, তবে ৯ তারিখেও রোজা রাখব।” (মুসলিম)

এক হাদিসে তিনি আরও বলেন, “যে ব্যক্তি আশুরার দিনে পরিবারকে ভালো খাবার খাওয়ায়, আল্লাহ তাআলা পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দেবেন।” (আবু দাউদ, তিরমিজি)

তবে আশুরা শুধু ঐতিহাসিক ঘটনাবলির স্মরণে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনারও এক স্মারক—যেখানে সত্য ও ন্যায়ের পথে অকুতোভয়ে আত্মত্যাগ করেন রাসুল (সা.)-এর দৌহিত্র, হজরত হোসাইন (রা.)।

হিজরি ৬১ সালের ১০ মহররম, কারবালার প্রান্তরে ঘটে ইতিহাসের অন্যতম করুণতম ঘটনা। মদিনা থেকে কুফাবাসীর আমন্ত্রণে হজরত হোসাইন (রা.) পরিবার-পরিজন নিয়ে রওনা দেন, কিন্তু সেখানে পৌঁছে তিনি প্রতারণার শিকার হন। তাঁকে কুফায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি, বরং পরিবারসহ আটকে রাখা হয় কারবালায়। শত্রুপক্ষ পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ছোট শিশু তৃষ্ণায় কাতর, নারীরা অশ্রুসিক্ত, আর হোসাইন (রা.) একে একে আপনজনদের বিদায় জানিয়ে নিজেও শহীদ হন—অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে।

কারবালার এই আত্মত্যাগের শিক্ষা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে। হজরত হোসাইন (রা.) স্পষ্ট করে বলে গেছেন, যে শাসক আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করে, জুলুম চালায়—তার বিরুদ্ধাচরণ না করা গুনাহ। কারবালার শিক্ষা হলো—জুলুমের সামনে মাথা নত না করে সত্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দৃঢ় থাকা, প্রয়োজনে আত্মত্যাগেও পিছপা না হওয়া।

আশুরার এই শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ইসলাম কেবল ইবাদতের নয়—বরং ন্যায়ের সংগ্রাম, নৈতিক শক্তি ও মানবিকতার ধর্ম।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি
সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম