‘সান্ডা’ দেখে কেউ হাসে আবার কেউ আতঙ্কিত, হারপেটোফোবিয়াকে অবহেলা নয়

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘সান্ডা’শব্দটি বেশ আলোচিত, হাসি-ঠাট্টা এবং রসিকতার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সরীসৃপ প্রাণীটি। কেউ বলছেন, ‘কফিলের জন্য সান্ডা ধরছি,’ কেউ আবার এআই দিয়ে সেলফি তৈরি করছেন সান্ডার সঙ্গে। নতুন এই ভাইরাল বিষয় অনেকের কাছে মজার বিষয় হলেও কারো জন্য এট ভীতিকর বিষয়। কথা বলছি ‘হারপেটোফোবিয়া’ বা সরীসৃপভীতি সম্পর্কে। অনেক মানুষই আছেন যারা গুঁইসাপ, সাপ, টিকটিকি বা অন্য যে কোনো সরীসৃপ প্রাণী দেখলেই আতঙ্কে অসাড় হয়ে পড়েন। এমনকি অনেক সময় প্যানিক অ্যাটাকের আশঙ্কা জাগিয়ে তোলে। ‘সান্ডা’ ট্রেন্ডের হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা হারপেটোফোবিয়া নিয়ে চ্যানেল 24 অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন লাইফস্প্রিং-এর কনসালট্যান্ট সাইকোলজিস্ট মিথীলা খন্দকার। চলুন জেনে নেয়া যাক সান্ডা হারপেটোফোবিয়া সম্পর্কে খুটিানটি।
হারপেটোফোবিয়া কী: ভয়ের অনুভূতি মানব মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, যা আমাদের সতর্ক করে এবং বিপদ থেকে রক্ষা করে। তবে সেই ভয় যখন মাত্রা অতিরিক্ত এবং দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তখন তা ফোবিয়ায় পরিণত হয়। এমনই এক নির্দিষ্ট ধরনের ফোবিয়া হলো ‘হারপেটোফোবিয়া’—যা সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীর প্রতি অসহনীয় ভয়কে বোঝায়। এদের মধ্যে রয়েছে সাপ, গিরগিটি, ব্যাঙ, টিকটিকি প্রভৃতি।
হারপেটোফোবিয়া একেবারেই হালকাভাবে দেখার বিষয় নয়। অনেক সময় আক্রান্ত ব্যক্তির আশেপাশের লোকজন তাকে বিষয়টি স্বাভাভিকভাবে গ্রহণ করতে বলে আবার কখনো তারাও ভয় দেখাই। এতে করে আক্রান্ত ব্যক্তির অনেক সময় প্যানিক অ্যাটাক হয়। ভয় পেয়ে অনেক সময় অজ্ঞান হয়ে যাবার ঘটনাও ঘটেছে।
হারপেটোফোবিয়ার উপসর্গসমূহ: মিথীলা খন্দকার হারপেটোফোবিয়ার বেশ কিছু উপসর্গ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, হারপেটোফোবিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি সরাসরি এসব প্রাণী দেখতে পেলেই নয়, কখনো কখনো ছবি বা ভিডিও দেখলেও প্রবল আতঙ্কে ভোগেন। সাধারণ উপসর্গগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বা দম বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতি
- হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া বা বুক ধড়ফড় করা
- অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, কাঁপুনি বা মাথা ঘোরা
- কান্না, চিৎকার, বা জড় হয়ে যাওয়া
- প্রাণীগুলোর আশেপাশে যাওয়া বা তাদের চিন্তা করাও এড়িয়ে চলা
হারপেটোফোবিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি সরাসরি এসব প্রাণী দেখতে পেলেই নয়, কখনো কখনো ছবি বা ভিডিও দেখলেও প্রবল আতঙ্কে ভোগেন। ছবি: সংগৃহীত
কারণ: হারপেটোফোবিয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে:
- শৈশবকালীন মানসিক আঘাত: ছোটবেলায় হঠাৎ সাপ বা গিরগিটি দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়া বা এমন কোন ঘটনা যা মনের ভেতরে ভয়ের বীজ বুনেছে।
- পরিবার বা সমাজ থেকে শেখা ভয়: পরিবারের সদস্যদের আচরণ বা কথাবার্তা থেকেও শিশু এসব প্রাণী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পেতে পারে।
- সংস্কৃতি ও মিডিয়ার প্রভাব: সিনেমা, নাটক বা গল্পে সাপ বা টিকটিকিকে ভয়ংকর রূপে উপস্থাপন করাও ভয়ের উৎস হতে পারে।
- জৈবিক প্রবৃত্তি: গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ প্রাকৃতিকভাবে কিছু বিপজ্জনক প্রাণীকে (যেমন সাপ) ভয় পেতে পারে। এটি জীববৈচিত্র্যের মাঝে টিকে থাকার একটি অংশ হিসেবেই বিবেচিত হয়।
প্রতিকার ও চিকিৎসা: ফোবিয়ার চিকিৎসা সম্ভব এবং যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা পেলে তা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। হারপেটোফোবিয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কিছু কার্যকর পদ্ধতি হলো:
- কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT): এই থেরাপির মাধ্যমে রোগী তার ভয়ের কারণ ও তা নিয়ে তার ভেতরের ভুল চিন্তাভাবনাগুলো চিহ্নিত করে তা পরিবর্তন করতে শেখেন।
- এক্সপোজার থেরাপি: ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে রোগীকে তার ভয়ের বস্তুটির মুখোমুখি করানো হয়, যার ফলে ধীরে ধীরে ভয় কমে আসে।
- মাইন্ডফুলনেস ও রিলাক্সেশন কৌশল: মেডিটেশন, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুশীলন ইত্যাদি মনকে শান্ত রাখতে সহায়তা করে।
- ওষুধ: অতিরিক্ত উদ্বেগ বা প্যানিক অ্যাটাকের ক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শে স্বল্প মেয়াদে কিছু অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে।
সবশেষে সাইকোলজিস্ট মিথীলা খন্দকার জানান, হারপেটোফোবিয়া অনেকের জন্যই একটি লজ্জার বা গোপন রাখার বিষয় হতে পারে, কিন্তু এটি একটি স্বীকৃত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যার কার্যকর চিকিৎসা রয়েছে। সচেতনতা, সহানুভূতি এবং সঠিক থেরাপির মাধ্যমে এই ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাই এই ধরনের ফোবিয়া নিয়ে লজ্জা নয়, বরং মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর যারা হারপেটোফোবিয়ায় আক্রান্ত তাদের এই বিষয়টি নিয়ে কোনও ভাবেই মজা করা উচিত নয়। কারণ যে ব্যক্তি এই সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তার পরিবার এবং কাছের লোকের সহানুভূতি দরকার। কোনও অবস্থাতেই এটাকে হালকাভাবে নেয়া উচিত নয়। আবার আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্বাভাবিক করতে গিয়ে নতুন করে ভয় দেখানো যাবে না, এতে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে।