প্রকৃতির কোল ভেসে গেল নিরস্ত্র মানুষের রক্তে, কেন সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিশানায় নিরপরাধ মানুষ

২৩ এপ্রিল ২০২৫ - ১৪:২৮ অপরাহ্ণ
 0
প্রকৃতির কোল ভেসে গেল নিরস্ত্র মানুষের রক্তে, কেন সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিশানায় নিরপরাধ মানুষ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্তির ছায়ায় মোড়ানো স্বর্গভূমি পেহেলগাম। এটি ভূ-স্বর্গ নামে পরিচিত কাশ্মীরের হৃৎকেন্দ্রে অবস্থিত। পেহেলগাম প্রকৃতির এক নিঃশব্দ কাব্য যেখানে তুষারাবৃত পর্বতচূড়া, পাইন-ডেউডারের ছায়াঘেরা অরণ্য, আর স্ফটিকস্বচ্ছ লিডার নদীর কলতান হাজারো প্রকৃতি-প্রেমীকে টানে। সব মিলিয়ে এটি এমন এক পর্যটক স্থান, যেখানে প্রকৃতির প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস মিশে আছে প্রশান্তিতে। গ্রীষ্মে সবুজ উপত্যকা আর শীতে শুভ্র বরফে মোড়া পাহাড়—পেহেলগামের সৌন্দর্য ঋতুর সঙ্গে পাল্টে যায়, ঠিক কবিতার ছন্দের মতো।
 
এখানে হেঁটে বেড়ানো মানে নির্মল প্রকৃতিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় উপভোগ করা। বিখ্যাত আরু উপত্যকা, বেতাব ভ্যালি ও চানদানওয়ারি —সবই যেন প্রকৃতির নিখুঁত তুলিতে আঁকা একেকটি ছবি।

কাশ্মীর ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে শুধুমাত্র পেহেলগামে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক ঘুরতে যান।এই সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে, বিশেষ করে করোনা-পরবর্তী সময় থেকে, কারণ মানুষ এখন শান্তিপূর্ণ, প্রাকৃতিক জায়গায় ফিরে যেতে আগ্রহী। দেশি-বিদেশি পর্যটক, অভিযাত্রী ও হানিমুন কাপল, তীর্থযাত্রীসহ সব ধরনের ভ্রমণপিপাসুদের জন্যই পেহেলগাম এক আদর্শ গন্তব্য।

সেই পর্যটনস্থল মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দুপুর ২টায় সশস্ত্রগোষ্ঠীর নির্বিচারে বন্দুক হামলায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। সেই বর্বরোচিত হামলায় সেখানে নিহত হন অন্তত ২৬ জন।  

পেহেলগাম হত্যাযজ্ঞ ও সশস্ত্রগোষ্ঠীর নির্মমতা বিশ্বের বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মূল লক্ষ্য সাধারণত রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা আদর্শগত উদ্দেশ্য পূরণ। কিন্তু যখন তারা তাদের হিংস্র উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নে নিরস্ত্র, নিরপরাধ বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে, তখন তা শুধু একটি হত্যাকাণ্ড থাকে না, বরং হয়ে উঠে মানবতার বিরুদ্ধে গভীর আঘাত। বিশেষত, পর্যটনস্থলকে কেন্দ্র করে এমন হামলা চালানো এক চরম অসভ্যতা এবং বর্বরতা—এটি শুধু মানুষের জীবন কেড়ে নেয় না, একটি ওই অঞ্চলের শান্তি, পরস্পরের সৌহার্দ্য ও অর্থনীতির ওপরও বড় ধরনের আঘাত হানে।

কখন ও কেন ঘটে এমন হামলা? সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিরীহ বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা করে মূলত তখনই—যখন তারা আতঙ্ক ছড়াতে চায়, যখন তারা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, অথবা যখন তারা নিজস্ব (রাজনৈতিক) বার্তা পাঠাতে চায়, যা অন্যভাবে পৌঁছানো সম্ভব নয়।

সাধারণ মানুষের রক্তে হাত রাঙিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে তারা। তারা জানে, একজন পর্যটককে হত্যা করা মানে শুধু একজন মানুষকে খুন করা নয়। এতে শুধু তার পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয় না, সেই দেশের শাসকগোষ্ঠীর ভাবমূর্তি ধ্বংস করা এবং একটি পর্যটননির্ভর অর্থনীতির ভিত কাঁপিয়ে দেয়া হয়।

ঝর্ণা, সবুজ উপত্যকা, তুষারাবৃত শিখর আর বয়ে চলা লিডার নদীর পাড়ে নিঃশব্দ শান্তি অনুভব করতে সেখানে ছুটে যান হাজারো মানুষ। কিন্তু ঠিক এমনই এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে সেখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় এক নব দম্পতিকে যখন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, তখন প্রশ্ন ওঠে—মানুষ কি প্রকৃতির মধ্যেও আর নিরাপদ নয়?
 
এই হত্যাযজ্ঞটি ছিল ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত। টার্গেট ছিল এমন এক ‘দম্পতি’ যারা নিছকই প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছিলেন, রাজনীতি কিংবা সংঘাতের কোনও অংশে জড়িত ছিলেন না। এই হত্যাকাণ্ড শুধুই পৈশাচিকতাই নয়, এটি একটি পর্যটনস্থলকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে  ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার বেশ কিছু নজির রয়েছে। মিশরের লুক্সোর মন্দিরে ১৯৯৭ সালে সশস্ত্র হামলায় ৬০ জন নিহত হন। তিউনিশিয়ায় সৈকতে পর্যটকদের ওপর চালানো নির্বিচারে বন্দুক হামলায় প্রাণ হারায় শতাধিক। তবে পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব আলাদা, কারণ এটি সংঘটিত হয়েছে এমন এক ভূখণ্ডে যেখানে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও হিংসা বিদ্যমান, এবং পর্যটনই যেখানে শান্তির একমাত্র আশ্রয় ছিল।

এ ধরনের হামলার পরিণতি কী হয়? স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটকদের মনে দীর্ঘস্থায়ী ভীতি ও নেতিবাচক মানসিক প্রভাব পড়ে। পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল অঞ্চলে আর্থিক বিপর্যয় নেমে আসে।

দেশটির সরকার এবং প্রশাসনের ওপর চাপ বাড়ে, কিন্তু কখনও কখনও এই চাপ ফের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী নির্মূলে অভিযানের নামে চলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই দেশ বা অঞ্চলকে সন্ত্রাসের আশ্রয়স্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. শ্রীনাথ রাও বলেন, 'এই হামলা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সন্ত্রাসবাদের কোনও মানবিক সীমা নেই। একজন পর্যটক যখন প্রকৃতির কোলে নিঃশব্দে সময় কাটাতে যান, তখন তাকে হত্যা করা মানে শুধু একজনকে নয়, মানবতার শান্তিপ্রিয় ইচ্ছাকেই হত্যা করা।'

এর আগে, শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই বলেন, শিক্ষা, ভ্রমণ, প্রকৃতি — এগুলো শান্তির প্রতীক। যখন এগুলোর সঙ্গে যুক্ত মানুষকে হত্যা করা হয়, তখন সেটা শুধু বর্বরতা নয়, শান্তির পথকে বন্ধ করে দেয়ার হীনতম চেষ্টা।' 

কাশ্মীরের একজন প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা ও সমাজকর্মী মীর ওয়াইজ উমর ফারুক বলেন, 'যারা পেহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের হত্যা করেছে, তারা কাশ্মীরের আতিথেয়তা, মানবতা ও সংস্কৃতিকে কলঙ্কিত করেছে। ইসলাম বা কোনও ধর্মই এমন নিষ্ঠুরতাকে সমর্থন করে না।' 

লেখক ও সমাজ বিশ্লেষক অরুন্ধতী রায় বলেন, 'আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝেও হত্যাযজ্ঞ এসে দাঁড়ায়। পেহেলগাম হত্যাকাণ্ড আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কাশ্মীর শুধু রাজনৈতিক মানচিত্রের বিষয় নয়—এটি এক মানবিক সংকটের নাম।'

এভাবে মানবতা কখনই পরাজিত হতে পারে না, যদি বিশ্ববাসী একযোগে প্রতিবাদ করে এবং ঐক্যবদ্ধ হয়। পেহেলগামের মতো নৈসর্গিক স্থানে এমন হত্যাযজ্ঞ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শুধু অস্ত্রধারীদের নয়, পর্যটনশিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং এমন অপরাধের নিন্দায় আমাদের কণ্ঠ ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে হবে—কারণ এই রক্তপাত কেবল স্থানীয় পর্যায় বা একটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা সমগ্র মানবজাতির হৃদয়ে আঘাত হানে।