‘কতদিন বাপরে দেখি না, আমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসে না’

দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে একের পর এক রাজনৈতিক মামলার ভার মাথায় নিয়ে পলাতক ছিলেন আব্দুল্লাহ কবির। বাড়িতে থাকতে পারতেন না, আত্মীয়দের বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হতো। অথচ শেষ পর্যন্ত নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই ঢাকার মিরপুরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন তিনি। তার একমাত্র স্বপ্ন ছিল- পুত্র আহনাফকে কুরআনের হাফেজ বানানো।
পলাতক জীবনের শেষ দিন
শহীদ কবিরের ছোট ভাই গাউসুল্লাহ রাজু জানান, আন্দোলনের দিন সকালে ভাই ব্যাংকে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আন্দোলনে যোগ দেন। পরে দুপুরে ম্যাক্স হাসপাতাল থেকে ফোন পেয়ে স্ত্রী ছুটে যান, কিন্তু সেখানে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। শেষমেশ কুর্মিটোলা হাসপাতালে কবিরের মৃত্যু হয়।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন দুপুরে পুলিশ কবিরের পরিবারকে লাশ হস্তান্তর করে। রাতেই মরদেহ নেয়া হয় চাঁদপুর সদর উপজেলার মৈশাদী ইউনিয়নের দক্ষিণ হামানকর্দি গ্রামে, নানা বাড়িতে। পরদিন জানাজা শেষে তাকে সেখানেই দাফন করা হয়।
জন্ম, সংগ্রাম ও পরিবার
তিনি ১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক এবং ১৯৯৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর কিছুদিন বিএ পড়লেও পরে ব্যবসায় মন দেন। ২০১২ সালে আফসানা আক্তারকে বিয়ে করেন। তাদের একমাত্র সন্তান আহনাফ খান (৯), স্থানীয় একটি মাদরাসায় হিফজ বিভাগে পড়ছে।
অসংখ্য মামলা, পরিবারে অনিশ্চয়তা
ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করায় তার বিরুদ্ধে দায়ের হয় ৩০-৪৫টি রাজনৈতিক মামলা। যার ফলে কবির প্রায়ই আত্মগোপনে থাকতেন। তার ভাই রাজু জানান, ব্যবসায়িক ঠিকানায় না পেয়ে পুলিশ দুইবার তাকে ধরে নিয়ে যায়, দুই দফায় কারাভোগ করতে হয় প্রায় ৯ মাস, যদিও তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।
বিচার ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা
কবিরের স্ত্রী আফসানা আক্তার গত বছরের ১৯ আগস্ট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলার আবেদন করেন। আদালত তা আমলে নিয়ে মিরপুর মডেল থানাকে এজাহার রেকর্ড করতে নির্দেশ দেন। মামলায় ৬৮ জনকে আসামি করা হয়।
অর্থকষ্টে নিঃস্ব পরিবার
শহীদ কবিরের মৃত্যুর পর তার পরিবার চরম অর্থকষ্টে রয়েছে। স্ত্রী আফসানা জানান, তার স্বামীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। নিজেও চাকরি না পাওয়ায় সন্তান নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে।
তিনি জানান, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, জামায়াত থেকে ২ লাখ এবং বিএনপির পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা পেয়েছেন। ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুদানের আবেদন করা হলেও এখনো কিছু মেলেনি।
চাঁদপুরের ঠিকানায় ৫৬ নম্বরে আব্দুল্লাহ কবিরের নাম গ্যাজেটে অন্তর্ভুক্ত হলেও বাস্তব সহযোগিতা নেই বলেই দাবি পরিবারের।
বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মায়ের আকুতি
৭২ বছর বয়সী সুরাইয়া বেগম, শহিদ কবিরের মা, এখন থাকেন মিরপুর পাইকপাড়া এলাকায় মেয়ে রুবির সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমি আমার বাবার বাড়িতে ছিলাম। ছেলের সঙ্গে আমার কথা হয় ৩০ ও ৩১ জুলাই। আন্দোলনের সময় ছেলের সঙ্গে থাকা লোকজন গুলিবিদ্ধ হয়। এসব খবর শুনে খুবই মন খারাপ। তখন থেকেই ছেলেকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করতাম। কিন্তু আমাদের কারো নিষেধ শোনে নাই। আন্দোলনে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ছেলে আমার প্রাণ হারায়।’
তিনি বলেন, ‘আমার অন্য সন্তানদের চাইতে কবিরই বেশি খোঁজ নিত। ছেলে আমার রাজনৈতিক মামলার কারণে ঠিকমতো বাড়িতে থাকতে পারেনি। তারপরও গোপনে এসে আমার খোঁজ-খবর নিত এবং আমার ওষুধ কিনে দিত। ছেলেকে হারিয়ে আমি এখন খুবই অসহায়। আজ কতদিন আমার বাপরে দেখি না, আমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসে না। এখন সরকারের সহযোগিতা চাই, আমার নিজের চলার মতো অবস্থাও নেই, তাই সরকারি আর্থিক সহায়তা দরকার আমার আর আমার নাতি ও পুত্রবধূর জন্য।’
শহীদ কবিরের ছোট বোন রুবি বলেন, ‘ভাই শহীদ হওয়ার পর ভাবি আলাদা থাকছেন। ভাই আগে মায়ের ওষুধ ও চিকিৎসাসহ সব খরচ দিতেন। কিন্তু এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি ভাড়া বাসায়, পরের ঘরে থাকি। এই অবস্থায় মায়ের চাহিদামত সহযোগিতা করাটা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।’