স্বাস্থ্যবিধি-নির্দেশনা না থাকায় ডেঙ্গু-কোভিডের সঙ্গে সিজনাল ফ্লু’কে মিলিয়ে জনমনে আতঙ্ক

২৮ জুলাই ২০২৫ - ১৪:০৭ অপরাহ্ণ
 0
স্বাস্থ্যবিধি-নির্দেশনা না থাকায় ডেঙ্গু-কোভিডের সঙ্গে সিজনাল ফ্লু’কে মিলিয়ে জনমনে আতঙ্ক

দেশজুড়ে বেড়ে চলেছে সিজনাল ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা ও দুর্বলতা নিয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসছেন চিকিৎসা নিতে। তবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো-এই ঋতুভিত্তিক ফ্লু সংক্রমণ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো জাতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যবিধি, জনসচেতনতামূলক নির্দেশনা বা সতর্কবার্তা দেয়া হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে বাবা-মায়েরা পড়ছেন চরম উদ্বেগ ও বিভ্রান্তিতে।

সরেজমিনে রাজধানীর একাধিক হাসপাতালে এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি, জনসচেতনতামূলক নির্দেশনা নজরে পড়েনি এই প্রতিবেদকের। এ প্রসঙ্গে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট ফেনী জেনারেল হাসপাতালের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘এবারের সিজনাল ফ্লু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হলেও সরকারিভাবে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি জারি করা হয়নি। ফলে দেশে বর্তমানে কত মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন-তা নিয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে না।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু হাসপাতালে আলাদাভাবে ডেঙ্গু ও ফ্লু কর্নার চালু করা হলেও, অধিকাংশ জায়গায় এখনো পর্যাপ্ত ডায়াগনসিসের সুযোগ নেই। এই মুহূর্তে অনেকেই সিজনাল ফ্লুতে ভুগছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন, বা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মতো অন্যান্য ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু যথাযথ পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় এসব আলাদা করে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।’

‍বিশেষজ্ঞদের মতে, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস শরীরে সক্রিয় থাকলে একসঙ্গে আরেকটি ভাইরাস সচরাচর সক্রিয় হয় না-তবে দেশের বাস্তবতায় যেহেতু কেউ কোভিড, কেউ ডেঙ্গু, কেউ ফ্লুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাই শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না কে আসলে কোন ভাইরাসে আক্রান্ত। সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিচ্ছে শিশুদের ক্ষেত্রে। ডা. ইকবাল বলেন, ‘৫–১৫ বছর বয়সী শিশুদের ডেঙ্গু হলে মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। অন্যদিকে দুগ্ধশিশুদের যদি কোভিড নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া অবস্থায় ভুল করে ইনফ্লুয়েঞ্জা ধরে চিকিৎসা দেয়া হয়, তবে ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।’

তিনি আরও জানান, বর্তমানে সরকারি হাসপাতালগুলোতে কোভিড পরীক্ষা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। অধিদপ্তর থেকে কিট সরবরাহ কমে যাওয়ায় এখন আর আগের মতো জ্বর-সর্দির রোগীদের কোভিড পরীক্ষা করানো সম্ভব হচ্ছে না।‍

চিকিৎসা খরচ বাড়ছে, আস্থা কমছে: সাধারণ জ্বর-সর্দির উপসর্গ নিয়ে মানুষ যখন বেসরকারি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হচ্ছেন, তখন প্রথম ভিজিটে ৫০০–১০০০ টাকা পর্যন্ত ফি দিতে হচ্ছে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বিপাকে পড়ছে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে মা-বাবারা অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে চিকিৎসক দেখাতে বাধ্য হচ্ছেন।

ডা. ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘যদি সরকার বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জাতীয় পর্যায়ে একটি স্বচ্ছ ও বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্য নির্দেশিকা দেয়া হতো, তাহলে মানুষ বুঝে নিতে পারত, কবে চিকিৎসক দেখাতে হবে আর কবে বাড়িতেই পরিচর্যা করলেই চলবে। এতে যেমন ‍অপ্রয়োজনীয় খরচ কমত, তেমনি আতঙ্কও নিয়ন্ত্রণে থাকত।’

সিজনাল ফ্লু এখন সারাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে ছড়িয়ে পড়েছে। ‍কোভিড বা ডেঙ্গু সংক্রমণের সঙ্গে উপসর্গ মিলে যাওয়ায় বিভ্রান্তি বাড়ছে। ‍সঠিক ডায়াগনসিসের অভাব মৃত্যুঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে, বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে।
কোভিড পরীক্ষার কিট সরবরাহ কম থাকায় রোগ নির্ণয়ে বড় ধরনের সংকট তৈরি হচ্ছে। ‍জাতীয় সতর্কবার্তার অভাবে জনসচেতনতা ও আত্মরক্ষার সুযোগও কমে যাচ্ছে।

‌একটি সঠিক সময়োপযোগী স্বাস্থ্যবিধি বা সরকারি সতর্কবার্তা শুধু ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখে না, বরং আতঙ্ক কমিয়ে দেয়, চিকিৎসকদের কাজকে সহজ করে এবং জনগণের আস্থা বজায় রাখে। 

সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এখনই উচিত-সিজনাল ফ্লু সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়ানো, সঠিক তথ্য প্রকাশ করা এবং শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ নির্দেশনা প্রচার করা। ঠান্ডাজ্বর অনেকটা সহনীয় হলেও পর্যাপ্ত নির্দেশিকা না থাকায় এই নিয়ে চিকিৎসা সেবায় এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

সিজনাল ফ্লু সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা এ ও ইনফ্লুয়েঞ্জা বি ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। এই দুই ধরনের ভাইরাসই প্রতিবছর সিজনাল (আবর্তনকারী) ফ্লু মহামারির কারণ যা বর্ষা বা শীতকালে ফ্লু ছড়িয়ে পড়ে।  ফ্লুর বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানভিত্তিক নাম
ইনফ্লুয়েঞ্জা এ এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা বি। 

ইনফ্লুয়েঞ্জা এ-এর অন্তর্গত সাধারণ উপধরনগুলোর মধ্যে রয়েছে এ(এইচ১এন১) পিডিএম০৯ ও এ(এইচ৩এন২) যা বিশ্বজোড়া সিজনাল ফ্লু এবং অতীতে মহামারির কারণ হয়েছে। ইনফ্লেসন-বি এর ক্ষেত্রে বি/ভিক্টোরিয়া ও বি/ইয়ামাগাটা লিনিয়েজ নামে পরিচিত। তথাপি, বি/ইয়ামাগাটা সম্ভবত ২০২০–২১ সালে বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। 

চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা আইইডিসিআর থেকে সিজনাল ফ্লুর বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট জাতীয় সতর্কবার্তা বা বিশেষ নির্দেশিকা জনসাধারণের জন্য  ইস্যু করা হয়নি। তবে নিম্নরূপ ব্যবস্থা ও কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে:

হাসপাতালভিত্তিক ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভেল্যান্স (এইচবিআইএস) ও জাতীয় ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভেল্যান্স ইন বাংলাদেশ (এনআইএসবি) ২০০৭ সাল থেকে আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর,বি ও ডব্লিউএইচও-র সহযোগিতায় পরিচালিত হয়। 

সংক্রমণের এপিডেমিক মৌসুম সাধারণত মে–সেপ্টেম্বর (বর্ষাকালে) এ ঘটে, যার সময়কাল গড়ে সাড়ে ১২ সপ্তাহ থাকে। জাতীয় কোনো ফ্লু ভ্যাকসিন নীতি বা কর্মসূচি নেই (স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া), ডব্লিউএইচওর সুপারিশ সত্ত্বেও চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য জনস্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ভ্যাকসিনেশন নেই। শুধুমাত্র হজ যাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিনামূল্যে সিজনাল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন দিয়ে থাকে সৌদি সরকারের বিধান অনুযায়ী। 

২০২৪–২৫ সালে একটি গবেষণা শুরু হয়েছে যা বাংলাদেশের উচ্চ‑ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সিজনাল ফ্লু ভ্যাকসিন কর্মসূচির গ্রহণযোগ্যতা, অর্থনৈতিক কার্যকারিতা, সহায়ক কর্মসংস্থান ও বাস্তবায়ন দর্শনাচর্চা করছে। এই কর্মসূচির ফলাফল আশা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে নীতি নির্ধারণে সহায়ক হবে।

সরকারি পর্যায়ে সতর্কবার্তা ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচির আওতায় সিজনাল ফ্লুর লক্ষণ কী, কবে চিকিৎকের কাছে যাওয়া প্রয়োজন, ঘরোয়া সেবা কতটা কার্যকর’-এসব জানানো গেলে অপ্রয়োজনীয় চেম্বারভিজিট কমে যাবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে শিশুস্বাস্থ্য সচেতনতা ক্যাম্প, ইউনিয়ন/ওয়ার্ড পর্যায়ে সপ্তাহ করে শিশুদের জন্য ফ্লু‑ক্যাম্প চালানো যেতে পারে।সেখানে মা-বাবাকে জানানো যেতে পারে-কবে সতর্ক হবেন আর কীভাবে। সরকারি উদ্যোগে (যেমন স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩) মাধ্যমে ৫–১০ টাকায় ফোন/অনলাইন পরামর্শ ছড়িয়ে দেয়া যায়।
 
সিজনাল ফ্লুর জন্য শিশু চিকিৎসায় ফি সহনীয় রাখতে বিশেষ করে গরিব রোগীর জন্য ভিজিট ফি কমানোর অনুরোধ বা অনুদানভিত্তিক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। মিডিয়া বা সামাজিক বার্তা আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে ‘সিজনাল ফ্লুতে প্রতিটি শিশুর জ্বর মানেই আতঙ্ক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই বাসায় বিশ্রাম, তরল খাবার আর সচেতন পরিচর্যাই যথেষ্ট। অপ্রয়োজনীয় চেম্বারভিজিট ও ব্যয় এড়াতে এখনই প্রয়োজন জনসচেতনতা ও দায়িত্বশীল চিকিৎসা-পরিবেশ।’