ভয়াবহ বন্যা: কেন এত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠল পাকিস্তান

১৭ জুলাই ২০২৫ - ১৪:০৯ অপরাহ্ণ
 0
ভয়াবহ বন্যা: কেন এত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠল পাকিস্তান

পাকিস্তানে গত তিন সপ্তাহে বন্যাসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা দুর্যোগে ১২০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে অর্ধেকই শিশু। দেশের জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (এনডিএমএ) জানিয়েছে, ২৬ জুন থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ৬৩ জনই শিশু। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যুর কারণ বাড়িঘর ধসে পড়া ও আকস্মিক বন্যা। আর ডুবে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে। 

২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার ক্ষত এখনো না শুকাতেই পাকিস্তান আবার নতুন বিপদের মুখোমুখি। সেই বছর এক হাজার ৭০০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছিলেন, তিন কোটিরও বেশি মানুষ ঘরহারা হয়েছিলেন এবং আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার।

সরকার একদিকে আন্তর্জাতিক সহায়তার ঘাটতির কথা বললেও, বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, সরকারের নিজস্ব অব্যবস্থাপনা এবং প্রস্তুতির ঘাটতিও এই দুর্যোগকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। এনডিএমএ-র সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে পাঞ্জাবে ৪৯ জন ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে ৩৮ জন। পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোরে, গত সপ্তাহে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা ও জলাবদ্ধতায় ভুগেছে।

সোয়াত উপত্যকায়, খাইবার পাখতুনখাওয়ায় এক পরিবারের নয় সদস্য পিকনিকে গিয়ে পানির স্রোতে ভেসে যায় এবং প্রাণ হারান।আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, আগামী দিনগুলোতে আরও শক্তিশালী মৌসুমি বৃষ্টিপাত হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বছরে মোট বৃষ্টির ৭০–৮০ শতাংশই হয় জুন-সেপ্টেম্বর মৌসুমে। তবে এবার দুর্যোগ আরও তীব্র হয়েছে উত্তরের গিলগিট-বালতিস্তানে অস্বাভাবিক গরমে – যেখানে তাপমাত্রা ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে, যদিও ওই অঞ্চল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২০০ মিটার উপরে অবস্থিত। 

গিলগিট-বালতিস্তানে রয়েছে ১৩ হাজারের বেশি হিমবাহ- যাদের গলন এখন আশঙ্কজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ‘গ্লেসিয়াল লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড’ (গ্লোফ) অর্থাৎ হিমবাহ থেকে হঠাৎ পানি বেরিয়ে ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা প্রবল। 

পরিবেশবিদ সিতারা পারভিন বলেন, ‘জুনের তাপদাহ গত ৩০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে, ফলে হিমবাহ দ্রুত গলতে শুরু করেছে। উচ্চ তাপমাত্রা ও বৃষ্টির যুগলবন্দি অতীতে ‘লিটল আইস এজ’ সময়েও ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি করেছিল।’ 

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ২০২৩ সালে বলেন, ‘পাকিস্তান বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের মাত্র ০.৫ শতাংশের জন্য দায়ী, অথচ জলবায়ু দুর্যোগে মৃত্যুর আশঙ্কা এখানে ১৫ গুণ বেশি।’ 

২০২৩ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান একটি আন্তর্জাতিক দাতা সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, যেখানে ১০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি মিলেছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের মধ্যে মাত্র ২.৮ বিলিয়ন ডলার হাতে পেয়েছে দেশটি। পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধান বলেছেন, ২০৫০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু মোকাবিলায় দেশটির প্রতি বছর ৪০–৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অব্যবস্থাপনার কারণে এই সংকট আরও ভয়াবহ হয়েছে। পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার বহু এলাকায় নদীর কিনারে অবৈধভাবে ঘর তৈরি হয়েছিল, যা সহজেই ভেসে গেছে।

২০২৩ সালের জাতিসংঘ বাসস্থান শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে দ্রুত শহরমুখী মানুষের চাপে ৫০ শতাংশ শহুরে মানুষ এখন বস্তি বা অননুমোদিত এলাকায় বাস করেন। এনডিএমএ জানিয়েছে, তারা এখন শুধু জরুরি প্রতিক্রিয়ার ওপর নয়, বরং ঝুঁকি হ্রাস ও আগাম সর্তকতার দিকেও জোর দিচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন পাকিস্তানের জন্য নিঃসন্দেহে একটি ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। তবে সঠিক পরিকল্পনা, টেকসই নগরায়ণ, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া এই দুর্যোগ থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এটি শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয়-এটি রাজনৈতিক ও মানবিক সংকটও।