রাষ্ট্র ও দল গঠনে নারী নেতৃত্বের ভুমিকা

রাষ্ট্র ও দল গঠনে নারী নেতৃত্বের ভুমিকা:
সাবেরা শরমিন হক
'মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান'।
কবিগুরুর অবিনাশী কবিতা দিয়ে শুরু করলাম এই জন্য যে, প্রকৃত সময় এসেছে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিএনপি'র টেকসই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার। শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নয় বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যে দল গঠিত সেই দলকে দেশের মানুষের স্বার্থে ও চাহিদার কথা বিবেচনা করে সৎ, মেধাবী, পরিশ্রমি,সুশিক্ষিত তরুণ- তরুণীদের নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে সংসদে আনতে হবে। বিশেষ করে দেশের প্রত্যকটি জেলাতে কমপক্ষে একজন করে সুশিক্ষিত যোগ্য তরুণীদের সাংসদ করে নেওয়া বেশ জরুরি। তারা পুরো জেলার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে মেধাবী রাজনৈতিক পরিবারের সুশিক্ষিত নারীদের সরাসরি দলে আনতে সক্ষম হবেন, যে কাজটা একজন পুরুষ সাংসদের পক্ষে যথেষ্ঠ কঠিন। আর নারীদের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করলে বিএনপির টেকসই রাজনীতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বিগত সময়ে রাজনৈতিক ভাবে যারা লড়াই সংগ্রাম করে বঞ্চিত আছেন তাদের বিএনপি'র রাজনৈতিক মাতৃক্রোড়ে আশ্রয় না দিতে পারলে দল সুসংগঠিত হতে পারে না।অতীতে কিছু চরিত্রহীন ব্যক্তি যারা বিএনপি'র মনোনয়ন নিয়ে সাংসদ, মন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে অবৈধ অর্থ বিত্বের পাহাড় গড়ে বেগম খালেদা জিয়া ও আমাদের নেতা তারেক রহমান বিপক্ষে বিষবাষ্প ছড়িয়ে ছিলেন। তারা দলকে মহা বিপদের গর্তে ফেলে দল ত্যাগ করে নতুন দল গঠন করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়ে গোপনে সুবিধা নিয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যরা যেন কোন ভাবেই নমিনেশন না পায় সেই দিকে দলের গুরুজনদের নজর রাখতে হবে। তা না পারলে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা ম্লান হয়ে যাবে।
ভাবনার সময় এসেছে সামনের নির্বাচনে যদি যথাপোযুক্ত ব্যক্তিদের দলীয় এমপি করতে আমরা ব্যার্থ হই তাহলে একদিন জনপ্রতিনিধির সংজ্ঞাও পাল্টে যেতে পারে, বিধায় সম্ভ্রান্ত, শিক্ষিত,সৎ, যোগ্যদের নির্বাচনে এগিতে নিয়ে জিয়াউর রহমানের স্বপ্নকে প্রতিষ্ঠিত করে বিএনপিকে রাজনৈতিক ভাবে চিরঞ্জীবী হতে হবে । মান-সম্মান মর্যাদা রক্ষার্থে এক সময় বিএনপির যে সব ত্যাগী, যোগ্য নেতারা নির্বাচন করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তাদের আজ বেশি প্রয়োজন।
সংগত কারণে আগামী নির্বাচনে সৎ যোগ্য, পরিশ্রমি, মেধাবী ত্যাগী,বিণয়ী নেতাকর্মি যেন দলীয় মনোনয়ন পান সেই ব্যাবস্থা করা অতি জরুরী। অন্যথায় পিছিয়ে পড়া বিপুল জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে তারেক জিয়া যে,পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন তাও তিমিরেই রয়ে যেতে পারে। তাতে বাংলাদেশ কে উন্নত রাষ্ট্র গঠণের যে স্বপ্ন বেগম খালেদা জিয়া দেখেছেন তাতেও প্রধান অন্তরায় হতে পারে।
আমার স্বর্গীয় পিতা একরামুল হক প্রতিষ্ঠাকাল থেকে নওগাঁ জেলা বিএনপির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। শুরুতে (সত্তর দশকে) জেনারেল জিয়াউর রহমান নওগাঁ জেলা বিএনপির রাজনীতি সু-সংগঠিত করার পবিত্র দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মেধা মননে সেই কাজটি করে গেছেন। বাবার হাত ধরেই নওগাঁতে বেগম খালেদা জিয়ার হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছি। জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতায় গানে প্রথম স্থান অধিকার করে পুরস্কার গ্রহণ এরপর ১৯৯৪ সালে এসএসসি মেধা তালিকায় নাম লিখে বেগম জিয়ার হাত থেকে তৃতীয় বার পুরস্কার গ্রহণ করা..তা আমার জীবনের আশির্বাদ। আমার কর্মজীবন চাকুুরি তারপর শিল্প ব্যবসা দিয়ে শুরু হলেও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই সুবাদে জন্মস্থান নওগাঁ, নিজ জেলা বগুড়া সহ দেশের বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেতে পেরেছি। ঢাকার অলিগলিতে ছুটেছি। কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে বিএনপির গ্রাম এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে। তাদের অভিযোগ অনুযোগের অন্ত নেই। মূল অভিযোগ নেতা - নেত্রি দের কলহ বিবাদ, দলের প্রসারের জন্য গ্রাম ও ওযার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ না করা। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে যতটা জেনেছি তাদের বিএনপির রাজনীতি নিয়ে কথা বলার সুয়োগ নেই বললেই চলে কারন হিসাবে বলেছেন ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যাযে কমিটি নেই, জেলা পর্যায়ে দু'একজনের নাম শুনলেও বছরে চোখের দেখা হয় না। তাদের অনুযোগ আমাদের নেতা দেশে ফিরে যেন প্রতিটি জেলা উপজেলায় সুশিক্ষিত, মেধাবী, সৎ যোগ্য নারীদের রাজনীতি করার প্লাটফর্ম তৈরী করে দেন। বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং নেতৃত্বে নারীদের অন্তর্ভুক্তি আজকের সময়ে অপরিহার্য। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে যে নারী নেতৃত্ব সংকট মোকাবিলায় কেবল মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেনি বরং স্থায়ী সমাধানের ভিত্তিও স্থাপন করেছে। তবুও, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নেতৃত্বে নারীদের উপস্থিতি এখনও অপ্রতুল।
উন্নয়ন ও অগ্রগতি নারী নেতৃত্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, রাষ্ট্র ও দল গঠনে নারী নেতৃত্বের বিকল্প নেই।
বিসিষ্ট নারী নেতৃত্ব শার্লি স্যান্ডবার্গ ২০১৩ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বলছেন, 'বিশ্বের সব সংসদ সদস্যদের হিসাবে দেখা যায় মাত্র ১৩ ভাগ নারী সংসদ সদস্য। কর্পোরেট খাতে নারীর সংখ্যা ১৫ থেকে ১৬ ভাগ। এ হিসাব ২০০২ সালের পর খুব একটা বাড়েনি বরং কমেছে।
মার্কিন থিংক ট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (সিএফআর) নারী এবং বৈদেশিক নীতি কর্মসূচী দ্বারা পরিচালিত উইমেন্স পাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, জাতিসংঘের ১৯৩ টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে আজ - রুয়ান্ডা, কিউবা, এবং নিকারাগুয়া - কেবল এই তিনটি দেশের সংসদে নারীরা ৫০ শতাংশের বেশি আসন দখল করে আছে।
সূচক অনুযায়ী, আরও তিনটি দেশ - মেক্সিকো, আন্দোরা এবং ইউএই - তাদের আইনসভায় ৫০/৫০ লিঙ্গ সমতা অর্জন করেছে।
আমাদের দেশে নারী নেতৃত্বের অবস্থানের পরিসংখ্যানে (২০২০) দেখা যায়, 'জাতীয় সংসদে ৩৫০টি আসনের মধ্যে ৬৮ জন নারী, এর মধ্যে ৫০টি সংরক্ষিত আসন, ১৮টি সাধারণ আসন, ৭৬ জন সচিবের মধ্যে ৭ জন নারী, ৬৪টি জেলা প্রশাসকের মধ্যে ৭ জন নারী, পুলিশ সুপার ৬৪ জনের মধ্যে ৪ জন নারী। পরিসংখ্যানে নেতৃত্ব অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ন্যূনতম অবস্থান দৃষ্টিগোচর হয়।
নারীদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। নারীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যখন নারী আন্দোলন জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন দাবি করছে, তখন ২০১৮ সালে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন ভিত্তিক নির্বাচন আরও ২৫ বছরের জন্য বহাল করা হলো'। এ সিদ্ধান্ত সঠিক বলে নারীরা মেনে নেননি তারা চেয়ে ছিলেন সরাসরি নির্বাচনে নারী'রা এগিয়ে যাবে।
নারী নেতৃত্ব এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন কেবল সময়ের দাবি নয় বরং এটি একটি সভ্যতার নৈতিক দায়িত্ব। নারী নেতৃত্ব কেবল সংকট নিরসনে কার্যকর নয় বরং এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গঠনের জন্য অপরিহার্য।
আমরা আশাবাদী তারেক জিয়া'র নেতৃত্বে বাংলাদেশের নতুন যে, বিএনপি জন্ম নিবে তাতে নারী নেতৃত্বের প্রসার ঘটবে।
-লেখক পর্যটন - আবাসন ব্যবসায়ী ও সাংস্কৃতিক কর্মী।