৭০ শতাংশ নারী জীবনসঙ্গী, স্বামী বা প্রেমিকের হাতে নির্যাতিত

নির্যাতনের শিকার নারীর চিকিৎসা ব্যয় গড়ে ২,৫১২ টাকা

১৫ জুন ২০২৫ - ১২:৪১ অপরাহ্ণ
 0
নির্যাতনের শিকার নারীর চিকিৎসা ব্যয় গড়ে ২,৫১২ টাকা

দেশের নারী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনো পারিবারিক ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যেই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’–এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তার বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ কোনো না কোনো সময়ে জীবনসঙ্গী, স্বামী কিংবা প্রেমিক বা অন্য পুরুষের হাতে শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার এক তরুণীর অভিজ্ঞতা তারই একটি উদাহরণ। যৌতুকের দাবিতে স্বামীর নির্যাতনের শিকার এই তরুণী জানান, একবার স্বামী তার তলপেটে এমনভাবে আঘাত করেন যে তাকে হাসপাতালে দুদিন চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। তিনি মায়ের কাছ থেকে জেনেছেন, ওই চিকিৎসার জন্য প্রায় ৫-৬ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছিল। দাম্পত্য জীবনের এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি দুই বছরের মধ্যেই আলাদা হয়ে যান।

একইভাবে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে যশোর থেকে সন্তানসহ একজন নারী প্রথম আলো কার্যালয়ে এসে জানান, তিনি স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তাকে সংসারে রাখতে চাচ্ছেন না তার স্বামী। এ ছাড়া স্বামীর শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হন তিনি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর ১১(গ) ধারায় মামলা দায়ের করতে গিয়ে তার খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) যৌথভাবে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে যাঁরা গত ১২ মাসে চিকিৎসা বা আইনি সহায়তা নিয়েছেন, তাঁদের গড়ে চিকিৎসা ব্যয় হয়েছে ২,৫১২ টাকা এবং আইনি সহায়তায় গড় ব্যয় ৪,১০৪ টাকা।

গ্রামীণ অঞ্চলে এই ব্যয় কিছুটা বেশি—চিকিৎসায় ২,৬৭২ টাকা এবং আইনি সহায়তায় ৩,৬৮০ টাকা। অপরদিকে, শহরাঞ্চলে চিকিৎসায় গড়ে ২,৩৯৪ টাকা এবং আইনি সহায়তায় ৪,৩৪১ টাকা ব্যয় হয়েছে।

এই জরিপটি বাংলাদেশের জন্য তৃতীয়বার পরিচালিত হয়। এর আগে ২০১১ ও ২০১৫ সালে এ ধরনের দুটি জরিপ হয়। রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১১ সালে যেখানে ৮০ শতাংশ নারী জীবনসঙ্গীর হাতে সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন, ২০১৫ সালে সেই সংখ্যা ছিল ৭৩ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জরিপে এ সংখ্যা ৭০ শতাংশ।

এছাড়াও, সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, গত ১২ মাসে ৪১ শতাংশ নারী সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন। আর বিস্তৃত সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে দেখা যায়, জীবদ্দশায় কমপক্ষে ৭৬ শতাংশ নারী এবং গত এক বছরে ৪৯ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রেমিক বা অন্য কোনো পুরুষের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৫ শতাংশ নারী।

এই জরিপে দেশজুড়ে শহর, গ্রাম, বস্তি এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকাসহ ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মোট ২৭,৪৭৬ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।

বিবিএসের ‘ইন্টিগ্রেটিং জিওস্পেশাল ইনফরমেশন উইথ জেন্ডার অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ প্রকল্পের পরিচালক ইফতেখাইরুল করিম বলেন, “এই জরিপের মাধ্যমে আমরা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার প্রকৃতি ও পরিসর বিশ্লেষণ করতে চেয়েছি।”

সহিংসতা সহ্য করেও নীরবতা

সিরাজগঞ্জের সেই তরুণী আইনি পথে না যাওয়ার কারণ হিসেবে জানান, মামলার জটিলতা ও সামাজিক লজ্জা তার জন্য বড় বাধা। দেনমোহর বাবদ দুই লাখ টাকা পাওনার বিষয়েও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি।

ঢাকার ২৫ বছর বয়সী আরেক নারী জানান, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেমিক তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। পরে তিনি জানতে পারেন প্রেমিক অন্যত্র গোপনে বিয়ে করেছেন। প্রতিবাদ করতে গেলে প্রেমিক ও তার পরিবারের হাতে মারধরের শিকার হয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

জরিপে বলা হয়, নির্যাতনের শিকার নারীদের ৬৪ শতাংশ বিষয়টি গোপন রাখেন। সামাজিক সম্মান রক্ষার চিন্তা, সন্তানদের ভবিষ্যতের ভয়, কিংবা সহিংসতাকে স্বাভাবিক মনে করাই এ ধরনের নীরবতার অন্যতম কারণ। মাত্র ৭ শতাংশ নারী আইনি পদক্ষেপ নেন। অথচ ৫১ শতাংশ নারীই জানেন না কোথায় অভিযোগ করতে হবে।

আর যাঁরা মামলা করেন, তাদের জন্য বিচার পাওয়া সহজ হয় না। ঢাকা জেলার পাঁচটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের ২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আসা ৭,৮৬৪টি মামলার মধ্যে ৯৭ শতাংশ মামলায় আসামিরা বিচার শুরুর আগেই মুক্তি পেয়ে যান কিংবা পরে খালাস পান—এই তথ্য উঠে এসেছিল প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানে।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (BIGD)-এর জ্যেষ্ঠ ফেলো মাহীন সুলতান মনে করেন, নির্যাতনের শিকার নারীদের একাধিকবার চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা নিতে হয়, যা ব্যয়বহুল। তিনি বলেন, “এই ধরনের সহিংসতা মোকাবিলায় সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থায় দ্রুততা ও সমর্থন বাড়ানো জরুরি। নির্যাতনের শিকার নারীকে সাহস দিয়ে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ।”