চলন্ত গাড়ি পানিতে পড়ে গেলে করণীয় কী, জানালেন বুয়েটের অধ্যাপক

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বুধবার ভোরে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তিন শিশুসহ একই পরিবারের সাত সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। বুধবার (৬ আগস্ট) ভোরে লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন ৮০ বছর বয়সী ফয়জুন নেসা, ৫৫ বছরের খুরশিদা বেগম, ৩০ বছর বয়সী কবিতা বেগম ও লাবনী বেগম এবং রেশমি আক্তার, লামিয়া আক্তার এবং মীম আক্তার নামের তিন শিশু। তারা লক্ষ্মীপুর জেলার চন্দ্রগঞ্জ থানার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের পশ্চিম চৌপল্লী গ্রামের বাসিন্দা।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনা শুধু নোয়াখালীতেই নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন দুর্ঘটনা হয়েছে। এমন আরও কিছু মর্মান্তিক দুর্ঘটনার একটি হয়েছিল ২০১৯ সালে পাবনায়। একটি প্রাইভেটকার ব্রিজের রেলিং ভেঙে নদীতে পড়ে যায়। এসময় পানিতে ডুবে মারা যান পাঁচজন। উদ্ধারকাজে জটিলতা দেখা দেয় কারণ গাড়ির গ্লাস খুলতে পারেননি আটকে পড়া যাত্রীরা।
২০২১ সালে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের পাশে একটি খালে চলন্ত গাড়ি পড়ে গিয়ে চার যাত্রীর মৃত্যু হয়। পরে জানা যায়, তারা জানালা খুলতে পারেননি এবং ভেতরে আটকা পড়েছিলেন। ২০২৩ সালে টেকনাফ থেকে কক্সবাজার ফেরার পথে একটি গাড়ি পাহাড়ি সড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ছড়াতে (নালার মতো) পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করা সম্ভব না হওয়ায় তিনজনের মৃত্যু হয়।
তবে প্রশ্ন হলো: এমন মুহূর্তে কী করা উচিত? পানিতে পড়ার পর গাড়ি কি সঙ্গে সঙ্গেই ডুবে যায়, নাকি কিছু সময় ভেসে থাকে? এবং সেই সময়টা কীভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে? এই নিবন্ধে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা হবে বাস্তব তথ্য, যানবাহন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অতীতের ঘটনার আলোকে।
জীবন বাঁচাতে করণীয় চারটি ধাপ সহজে মনে রাখার জন্য ‘এসএসডব্লিউজি’ সূত্রটি মনে রাখতে হবে। প্রথম করণীয়টি হচ্ছে স্টে কাম (Stay Calm) বাংলায় স্থির থাকুন। আতঙ্কগ্রস্ত হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু চিৎকার বা হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করলে বেশি অক্সিজেন খরচ হয়। দ্রুত পরিস্থিতি বুঝে নিতে চেষ্টা করুন। দ্বিতীয়ত সিটবেল্ট খুলে ফেলুন (Unlock Seatbelt)। অনেক সময় এটি গলায় বা শরীরে আটকে থাকতে পারে, তাই দ্রুত সরে আসতে প্রস্তুত হতে হবে। তৃতীয়ত জানালার (উইন্ডো) গ্লাস নামিয়ে দিন (Open Window)। বেশিরভাগ গাড়ির পাওয়ার উইন্ডো পানিতে পড়ার কিছু সময় পর্যন্ত কার্যকর থাকে সেই সময়টাতে জানালা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। চারপাশের পানির তীব্র চাপে দরজা খোলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যদি পাওয়ার উইন্ডো কাজ না করে, তাহলে গ্লাস ভাঙার চেষ্টা করতে হবে। সামনের উইন্ডোগুলো সাধারণত নিরাপত্তা গ্লাস দিয়ে তৈরি থাকে, তাই সহজে ভাঙা যায় না। কিন্তু পেছনের গ্লাস বা সাইড গ্লাস (কর্নার উইন্ডো) তুলনামূলক সহজে ভাঙা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মাথা ঠুকবেন না-বরং ধাতব বস্তু (যেমন হেডরেস্টের নিচের দণ্ড বা বিশেষ হ্যামার) ব্যবহার করে গ্লাসের এক কোনায় আঘাত করতে হবে। চতুর্থত: প্রতীক্ষা না করে বেরিয়ে পড়তে হবে (গো আউট ইমেডিয়েটলি)। অনেকে ভুল করে ‘গাড়ি ভেসে থাকবে’ বা ‘দেখা যাক’ এমন সব ভেবে সময় নষ্ট করেন। এটি প্রাণঘাতী হতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব জানালা দিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে এবং অন্যদেরও সহায়তা করতে হবে।
গাড়ির ভেতর শিশু বা বৃদ্ধ থাকলে আগে নিজের পাশের জানালা খুলতে হবে এবং বাতাস ঢুকার ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর একজন একজন করে বের করে আনার চেষ্টা করতে হবে। এক্ষেত্রে নিজে আগে বেরিয়ে তাদের টেনে বের করে আনাই বেশি কার্যকর হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, ‘এয়ারকন্ডিশনযুক্ত লিক-প্রুফ গাড়ি পানিতে পড়ে গেলে কিছুটা সময় ভেসে থাকে। তবে নন-এসি গাড়ি যেগুলোতে জানালার গ্লাস খোলা থাকে বা যেগুলো সহজে খোলা যায় সেসব যান দ্রুত ডুবে যায়। এই সব যানের সুবিধা হচ্ছে এতে প্রাণহানি কম হয় কারণ আটকে পড়া যাত্রী অনেকটা সহজে জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। তবে এমন পরিস্থিতিতে এসিযুক্ত যানে প্রাণহানি বেশি হয়।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের এই অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক আরও বলেন, ‘যাত্রীবাহী বাসের ক্ষেত্রে সবাই একযোগে দরজা দিয়ে বের হবার চেষ্টা করলে পদদলিত হয়ে মৃত্যু হতে পারে। সেক্ষেত্রে সময় নষ্ট না করে জানালার গ্লাস খুলে বা ভেঙে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।’
গাড়ি ডুবে যেতে সময় লাগে, এই ধারণা আংশিক সত্য। হ্যাঁ, গাড়ি সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যায় না, তবে আটকে পড়া যাত্রীদের শুধু কয়েক সেকেন্ড বা এক–দুই মিনিটের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অনেকেই সময় নষ্ট করেন জানালা খোলার চেষ্টা না করে দরজা খোলার চেষ্টা করে-যা পানির তীব্র চাপের কারণে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে একটি লাইফ হ্যামার বা উইন্ডো ব্রেকার গাড়িতে রাখতে হবে। এগুলো ছোট, হালকা ও সহজে ব্যবহারযোগ্য। গ্লাভ-বক্স বা দরজার পাশে রেখে দিলে বিপদে পড়লে দ্রুত কাজে লাগতে পারে।
জীবনের চূড়ান্ত মুহূর্তগুলো অনেক সময় মাত্র ৩০ সেকেন্ডের যথাযথ সিদ্ধান্তে পাল্টে দেয়া যেতে পারে। সড়কপথে যাতায়াতের সময় শুধু দুর্ঘটনার ভয় নয়-গাড়িসহ পানিতে পড়ার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্যও মানসিক প্রস্তুতি থাকা জরুরি। আর এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ারে শুধু নিজেকে নয়, অন্যকেও বাঁচানো সম্ভব।