শুধু কি ভূমিকম্পের পরই জন্ম নেয় ভয়ংকর সুনামি, কেন এর ঢেউ এত প্রাণঘাতী

৩০ জুলাই ২০২৫ - ১৩:৫৫ অপরাহ্ণ
 0
শুধু কি ভূমিকম্পের পরই জন্ম নেয় ভয়ংকর সুনামি, কেন এর ঢেউ এত প্রাণঘাতী

রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপের উপকূলবর্তী এলাকায় বুধবার (৩০ জুলাই) ভোরে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার অতি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এটি ছিল ১৯৫২ সালের পর এই অঞ্চলটিতে অন্যতম প্রলয়ংকরী ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পের পরপরই জাপান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়। বিশেষজ্ঞরা জানান, সমুদ্রের সাধারণ ঢেউয়ের চেয়ে সুনামির ঢেউ অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে থাকে-এমনকি দেখতে খাটো মনে হলেও। সমুদ্রের সাধারণ ঢেউ কেবলমাত্র পানির উপরিভাবে সৃষ্ট হয়। কিন্তু সুনামির বিধ্বংসী ঢেউ তৈরি হয় একসঙ্গে বিশাল জলরাশি সরে যাওয়ার মাধ্যমে। তাই এর শক্তি হয় অসম্ভব রকমের বেশি। তাই তুলনামূলকভাবে ছোট ঢেউও ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক এবং প্রাণঘাতী হতে পারে। 

পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আঘাত হানা ভয়ংকর সব সুনামিতে সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী  সুনামিটি আঘাত হানে ২০০৪ সালে ২৬ ডিসেম্বর। ৯ দশমিক ১ মাত্রার প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পটি সুমাত্রার উপকূলে আঘাত হানে। এর ফলে সৃষ্ট সুনামিতে ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত, থাইল্যান্ডে প্রাণ হারায় কমপক্ষ দুই লাখ ৮০ হাজার মানুষ। ২০১১ সালে জাপানের হানসু উপকূলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট সুনামিতে প্রাণ হারান কমপক্ষে ২০ হাজার। ১৮৮৩ সালে ক্রাকাতোয়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও সুনামিতে নিহত হন কমপক্ষে ৩৬ হাজার মানুষ। ১৭৫৫ সালে ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামিতে মৃতের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০-৫০ হাজার। ১৯৭৬ সালে ফিলিপাইনের মিনদানাও এলাকায় ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামিতে প্রাণ হারান আট হাজার মানুষ। 

এবার দেখে নেয়া যেতে পারে সুনামি কীভাবে গঠিত হয়, এর পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী, এবং কেন উপকূলবর্তী দেশগুলোকে ভূমিকম্পের পরেই সজাগ থাকতে হয়।

‘সুনামি’ শব্দটির অর্থই হলো ‘বন্দর সদৃশ তরঙ্গ’ (হার্বার ওয়েব)। এটি একধরনের দৈত্যাকার সমুদ্র-তরঙ্গ, যা সাধারণত সাগর-মহাসাগরের তলদেশে আঘাত হানা ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্টি হয়। তবে শুধু ভূমিকম্পই নয়-সমুদ্রের তলদেশে ভূমিধস, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বা বিরল ক্ষেত্রে মহাজাগতিক উল্কাপিণ্ড পতনের কারণেও সুনামি তৈরি হতে পারে।

যেভাবে জন্ম নেয় সুনামি: পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে একাধিক বিশাল ‘টেকটোনিক প্লেট’ রয়েছে, যা সবসময় নড়াচড়া করছে। যখন একটি প্লেট আরেকটির নিচে ঢুকে যায় (এই অঞ্চলকে বলা হয় সাবডাকশন প্লেস), তখন সেখানে প্রচুর পরিমাণ শক্তি জমা হতে থাকে। অনেক বছর ধরে জমে থাকা এই ভূ-শক্তি হঠাৎ করে নির্গত হলে সমুদ্রের তলদেশ এক লাফে উপরে বা নিচে সরে যায়। এই উল্লম্ব সঞ্চালন সাগরের বিশাল জলরাশিকে ছিটকে সরিয়ে দেয়। সাগরের তলদেশ সরে যাওয়ার কারণে উঁচু-নিচু হয়ে যাওয়া জলরাশি অসাধারণ গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোই পরিণত হয় সুনামি তরঙ্গে।

গভীর সমুদ্রে সুনামির তরঙ্গ সাধারণত খুব দীর্ঘ (দৈর্ঘ্য প্রায় ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে), কিন্তু উচ্চতায় মাত্র এক মিটার মতো হয়। এগুলো ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলে, অর্থাৎ এক যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের গতির কাছাকাছি। তাই জাহাজে থাকা ব্যক্তিরাও অনেক সময় বুঝতেই পারেন না, যে তারা একটি সুনামি তরঙ্গের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। 

যখন এই দ্রুতগামী তরঙ্গগুলো উপকূলের দিকে ছুটে চলে, তখন সাগরের তলদেশ ক্রমশ উঁচু হতে থাকে, ফলে তরঙ্গের গতি কমে যায়। কিন্তু পেছন থেকে আসা বিশাল জলরাশির চাপ একই থাকে। ফলে ধীর গতিতে আসা সামনে থাকা জলরাশি উপরের দিকে ফুলে উঠে বিশালাকার দেয়ালের মতো রূপ নেয়। এ কারণে এগুলো সাধারণ ঢেউয়ের মতো ভেঙে পড়ার পরিবর্তে, দেয়ালের মতো হঠাৎ উপকূলে উঠে আসে। আর মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে যায় গোটা শহর, গ্রাম, বন, কৃষিক্ষেত্র এবং মানুষ।

কেন সুনামির ঢেউ এত বিধ্বংসী: সুনামি বিশেষজ্ঞ জাপানি বিজ্ঞানী কুবোতা তাতসুয়া সুনামির ভয়াবহ বাস্তবতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রের সাধারণ ঢেউয়ের চেয়ে সুনামির ঢেউ অনেক বেশি বিপজ্জনক-এমনকি দেখতে ছোট মনে হলেও! সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কুবোতা তাতসুয়া বলেন,‘সাধারণ সমুদ্রের ঢেউ কেবলমাত্র পানির উপরিভাবে সৃষ্ট হয়। কিন্তু সুনামি হয় পুরো পানির স্তম্ভ (ওয়াটার কলাম) একসঙ্গে সরে যাওয়ার মাধ্যমে। তাই এর বিধ্বংসী শক্তি হয় অসম্ভব রকমের বেশি। এমনকি এ সময় তুলনামূলকভাবে ছোট ঢেউও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক হতে পারে।’ 

তাতসুয়া আরও বলেন,‘যদিও পূর্বাভাস অনুযায়ী ঢেউয়ের উচ্চতা খুব বেশি নাও হয়, তবুও উপকূল থেকে দূরে থাকা এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।’ তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘সুনামির প্রথম ঢেউটি বড় না হলেও পরবর্তীতে এর ঢেউয়ের উচ্চতা ও ধ্বংসক্ষমতা অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে—আজ জাপানেই এর প্রমাণ মিলেছে। অনেক সময় একাধিক ঢেউ কয়েক ঘণ্টা ধরে আসতে পারে। তাই প্রথম ছোট ঢেউ দেখে আত্মবিশ্বাসী হয়ে সৈকতে ফিরে যাওয়া বিপজ্জনক।’

সুনামির গতিপ্রকৃতি ও আচরণ ব্যাখ্যা করতে ভূগোলবিদ এবং সমুদ্রবিজ্ঞানীরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজ করছেন। উপগ্রহ চিত্র, বুয়ি সেন্সর, সিসমিক রিডার এবং কম্পিউটার মডেলিংয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এখন আগাম সুনামি সতর্কতা দিতে সামর্থ্য হচ্ছেন। তবে এর জন্য সময় খুবই সীমিত—বিশেষ করে উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দা বা পর্যটকের জন্য।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চল হচ্ছে ‘রিং অব ফায়ার’। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের চারপাশে বিস্তৃত একটি এলাকা, যেখানে বহু সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে। এই অঞ্চলেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ সুনামি ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হয়ে থাকে। 

বিশ্বজুড়ে প্রায় ৪০ কোটির বেশি মানুষ উপকূলীয় এলাকায় বসবাস করে, যারা সুনামির ঝুঁকিতে রয়েছেন। তাই সুনামির আগাম সতর্কতা পদ্ধতি আরও উন্নত করা, উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো এবং দ্রুত সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি গড়ে তোলা ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো বিকল্প নেই।