দিন দিন ধর্ষণপ্রবণতা বেড়েই চলছে
সামাজিক অবক্ষয়ের এক কালো অধ্যায় ধর্ষন

সামাজিক অবক্ষয়ের এক কালো অধ্যায় ধর্ষন
বর্তমানে ধর্ষণ দেশের আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি। দিন দিন ধর্ষণপ্রবণতা বেড়েই চলছে। চারদিকে ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে ধর্ষণের মহামারি। পত্রিকার পাতা, টেলিভিশনের পর্দা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম খুললেই সবার আগে ধর্ষণের খবর আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। বর্তমানে ধর্ষণ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একনজরে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলাঃ
২০২৪: জানুয়ারি–জুলাই ১০,৭০৪টি
২০২৪: আগস্ট–ডিসেম্বর ৬,৮৬৭টি
২০২৫: জানুয়ারি ১,৪৪০টি
সূত্র: পুলিশ সদর দপ্তর
বর্তমানে ধর্ষন বেড়ে যাওয়ার কারনঃ
মানুষের আইন মানার প্রধান কারণ হলো শাস্তির ভয়। আর এর ফলে মানুষ নিজেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে ভয় পায়। কিন্তু মানুষ যখন দেখে সে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে, তাকে কোনো বিচার বা শাস্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে না, তখন সে আর কোনো আইনকে তোয়াক্কা করে না, তার মাঝে কোনো শাস্তির ভয় থাকে না। আর তখনই অপরাধ দুর্বার বেগে বেড়ে চলে।দেশে বর্তমানে ধর্ষণ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া এর জ্বলন্ত উদাহরণ।
কে বা কারা এমন নেক্কারজনক কাজে জড়িতঃ
অনেকে মনে করেন, একজন তরুণ বা যুবক বা যেকোনো বয়সের লোক ধর্ষক হয়ে ওঠার পেছনে তার পরিবারের বড় ভূমিকা রয়েছে। কারণ, পরিবারে যদি শৈশব থেকেই তাকে মানবিক মূল্যবোধ এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, বন্ধুত্ব এবং অপরাধের বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে শেখানো না হয় বা তাকে যদি অপরাধের ইহকালীন ও পরকালীন (সব ধর্ম অনুযায়ী) শাস্তি সম্পর্কে অবহিত করা না হয়, তাহলে যেকোনো অপরাধ করার আগে এর সম্ভাব্য শাস্তি সম্পর্কে তার মনে ভয় তৈরি হবে না।
ধর্ষকদের নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতামতঃ
কোন কারণে সেই লোকটি এই অপরাধ করেছে, সেই কারণ অনুসন্ধান করা গেলেই বরঞ্চ ভবিষ্যতে সেই অপরাধকে কমানো সম্ভব। তাই শাস্তির চাইতে অপরাধের কারণ অনুসন্ধান জরুরী। এর ওপরই ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আধুনিক সময়ের অপরাধ বিজ্ঞান এবং অপরাধ মনস্তত্ত্ব। দীর্ঘদিন ধরে অপরাধীদের ওপর গবেষণা করে জানার চেষ্টা হয়েছে, তারা কেন অপরাধ প্রবণ হয়। জেলখানায় নানা পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে এই নিয়ে। কয়েদিদের ওপর অনেক গবেষণা করা হয়েছে দীর্ঘদিন। অতীতের ঠিক কোন কোন ঘটনা তাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, এ বছরের ফেব্রুয়ারির ২৮ দিনে ধর্ষণের অভিযোগে দিনে গড়ে ১২টি মামলা হয়েছে। আগের বছরের ফেব্রুয়ারির ২৯ দিনে এই সংখ্যা একই ছিল। গত বছর সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এই আইনে এ বছরের জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি। গত বছরের জানুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৩।
মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় দেশের নাগরিক সমাজ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। অব্যাহতভাবে চলতে থাকা নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, নারীদের দলবদ্ধভাবে হেনস্তা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাতে–দিনে প্রতিবাদ হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সড়কে। প্রতিবাদ চলার সময়েও নারী–শিশু ধর্ষণের পরপর কয়েকটি ঘটনা উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। এ পরিস্থিতির মধ্যে একটি আলোচিত শিশু ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির জামিনে বেরিয়ে আসার ঘটনা ঘটেছে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনে গাজীপুরের শ্রীপুরে আরেকটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বনের ভেতর নির্জন স্থানে আরমান মিয়া নামের এক ব্যক্তি শিশুটিকে ধর্ষণ করে সে দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করেছেন এবং সেই ভিডিও ক্লিপ তিন বন্ধুকে পাঠিয়েছেন। ওই ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে এলাকাবাসী পুলিশের জিম্মায় দেন। একই দিনে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন মোজাম্মেল হক মানিক নামের এক শিক্ষক। ৮ মার্চ রাতে কেরানীগঞ্জে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে। মামলার পর আশরাফুল ও দীপ সরকার নামের দুই অটোরিকশাচালককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
২০১৬ সালে দিনাজপুরে যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেন প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় সাইফুলের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আদালত থেকে জামিন নিয়ে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর জেলা কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন তিনি। এ ঘটনায় ক্ষোভ সৃষ্টি হলেও আসামিকে আবার কারাগারে পাঠানোর মতো কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ওই শিশুর বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেছেন, আসামি চোখের সামনে ঘুরেফিরে। তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে এখন ঘর থেকে বের হতে চান না। মাগুরার সেই শিশুটির মা বললেন, ‘ইশ্! ক্যান যে পাঠাইছিল।
নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিদের মতে, নারী ও পুরুষের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও অপরাধকে ছোট করে দেখার কারণে অপরাধীরা অপরাধ করার প্রশয় পাচ্ছে। অপর দিকে মামলা হওয়ার পর দীর্ঘ সময় নিয়ে তদন্ত করা, ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ প্রতিবেদন আবশ্যক—সেই প্রতিবেদন দেরিতে দেওয়া, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, বড় অপরাধেও আসামির জামিন হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় অপরাধ বাড়ছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয় ৮ আগস্ট। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট সক্রিয় না হওয়ায় সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। নারী ও শিশু এখানে বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছে।
পথে, মাঠে, ঘরে নারীর প্রতি বিদ্বেষ-সহিংসতাঃ
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক অস্থিরতার সময় নারী ও শিশুর প্রতি যৌন–সন্ত্রাস বাড়ে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। ৫ আগস্টের পর অনেক কয়েদি পালিয়েছেন। এখন নারীবিদ্বেষী প্রচারও বাড়ছে। আর বিচার না হওয়ার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি তো এ দেশে রয়েছেই। এ সুযোগগুলো নিচ্ছে অপরাধীরা। শুধু নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সবাইকে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সারা দেশের থানা ও আদালতে কতসংখ্যক ধর্ষণের মামলা হয়েছে, সে তথ্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাওয়া গেছে। এ সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৩৩২। ওই ৯ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে হওয়া মোট মামলার ৩৪ শতাংশ ধর্ষণের। এ ছাড়া ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৮৭০টি।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর তথ্য অনুসারে, গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সাত মাসে ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ জানিয়ে কল এসেছে ৩৪৮টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের যেসব ঘটনা গুরুতর হয়, সেসব উঠে আসে সংবাদ মাধ্যমে। এর বাইরে অনেক খবর আড়ালেই থেকে যায়। নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন বিষয়ে ১৬টি জাতীয় দৈনিকের তথ্য সংকলন করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ জানিয়েছে, গত বছর নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের ২ হাজার ৫২৫টি খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ৭ মাসে ১ হাজার ৬৬৪টি ও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে ৮৬১টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ৩৪৫ জন ধর্ষণ, ১৪২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৩ জনকে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন ছয়জন। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক নারী ও শিশু নির্যাতন, এ–সংক্রান্ত মামলা ও বিচার পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক গবেষণা করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সামাজিক ও আইনি কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় অপরাধের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমে যাচ্ছে। ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে। নির্যাতনের চিত্র আগের ধারাতেই রয়েছে। ২০২০ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে হওয়া মামলায় বিচারের হার শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। এটা খুব উদ্বেগজনক চিত্র। এমন বিচারব্যবস্থা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া নির্যাতন না কমার বড় কারণ।
ধর্ষন প্রতিরোধে সরকারের নতুন উদ্যোগঃ
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। আর ধর্ষণের মামলার বিচার ১৮০ দিনের পরিবর্তে ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করা হবে। ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ সনদ প্রয়োজন হয়। অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে সংশোধনী আনা হবে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিচারক যদি মনে করেন, শুধু চিকিৎসা সনদের ভিত্তিতে এ মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ পরিচালনা সম্ভব, তাহলে তিনি সে রকম ব্যবস্থা নিতে পারবেন। ২০২০ সালে সিলেট ও নোয়াখালীতে দলবদ্ধ ধর্ষণের দুটি ঘটনায় দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই সময় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এর অধীন ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড এবং ধর্ষণের মামলার আসামি শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয় সরকারের নতুন উদ্যোগের ব্যাপারে অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, তদন্ত ও বিচারের সময় কমানো ভালো সিদ্ধান্ত। তবে তিনি ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক বহাল রাখার ওপর জোর দিয়ে বলেন, প্রকৃত আসামি শনাক্ত করতে বিশ্বজুড়ে ডিএনএ–ব্যবস্থা স্বীকৃত। ডিএনএ প্রতিবেদনের ব্যবস্থা না থাকলে ভুয়া মামলা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য উপজেলা পর্যায়ে ডিএনএ সংরক্ষণের জন্য আধুনিক যন্ত্র থাকা উচিত।