মানবপাচার চক্রের ভয়ঙ্কর ফাঁদে নিঃস্ব পরিবার

২১ জুন ২০২৫ - ১২:৪৩ অপরাহ্ণ
 0
মানবপাচার চক্রের ভয়ঙ্কর ফাঁদে নিঃস্ব পরিবার

মাদারীপুরে সক্রিয় মানবপাচার চক্রের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে একটি পরিবার। ইতালি যাওয়ার আশায় ২০ লাখ টাকা দিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিথিরপাড়ার জুয়েল বেপারী। দেশে ফিরে মানবপাচারের অভিযোগে মামলা করায় উল্টো তার দুই ভাইকে একটি ভুয়া হত্যা মামলায় আসামি করেছে দালাল চক্র। 

মামলার সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার একটি হত্যা মামলায় ভুক্তভোগী জুয়েলের ভাইদের ৪ ও ৫ নম্বর আসামি করা হয়েছে। যেখানে বাদী আসামিদের চেনেন না, আর আসামিরাও চেনেন না বাদীকে। বিষয়টি জেলা পুলিশকে জানালে তারা মানবপাচারকারীদের এই কৌশল ধরতে সক্ষম হন এবং ভুক্তভোগী পরিবারকে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেন।

ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে, ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে মাদারীপুর সদর উপজেলার তিথিরপাড়া গ্রামের জুয়েল বেপারী স্থানীয় মানবপাচারকারী রুবেল বেপারীর কাছে ধার-দেনা করে ২০ লাখ টাকা দেন। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি রওনা দেন। লিবিয়ায় পৌঁছালে রুবেল বেপারী তাকে ‘গেম হাউজে’ আটকে রাখেন এবং কিছুদিন পর মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেন। এরপর শুরু হয় নির্যাতন। রুবেল একাধিকবার পরিবারের কাছ থেকে অর্থ দাবি করে। বাধ্য হয়ে জুয়েলের পরিবার ভিটেমাটি বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকা পাঠিয়ে তাকে দেশে ফেরত আনে।

বাড়িতে ফিরে এসে জুয়েল ২০২৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুর সদর মডেল থানায় মানবপাচার আইনে রুবেল বেপারী ও তার ভাইসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলা দায়েরের পর থেকেই রুবেল ও তার সহযোগীরা পলাতক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জুয়েল মামলা করায় ক্ষুব্ধ হয়ে রুবেল তার আত্মীয় রাজৈর উপজেলার পূর্ব শাখারপাড় গ্রামের নূর ইসলাম মোল্লার নামে দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় জুয়েলের বড় ভাই সুলতান বেপারী ও রাসেল বেপারীকে ৪ ও ৫ নম্বর আসামি করেন। অথচ এই মামলার বাদী নূর ইসলাম ও আসামিদের মধ্যে কোনো পরিচয় নেই।

এ নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে বাদী ও আসামিদের মুখোমুখি করা হলে উভয় পক্ষ একে অপরকে চিনতে অস্বীকার করেন। বাদী নূর ইসলাম বলেন, ‘আপনারা কারা? আমি আপনাদের কখনো দেখি নাই। আমার ছেলে মারা যাওয়ার পর মামলা করেছি, কিন্তু কাদের আসামি করা হয়েছে জানি না। আমার চাচাতো ভাই বেলায়েত মোল্লা হয়তো আপনাদের নাম দিয়েছে। তবে আমি পুলিশ ও আদালতে বলবো, আপনাদের আমি চিনি না।’

আসামি রাসেল বেপারী বলেন, ‘আমি কখনোই বাদীকে দেখি নাই। আমাদের আসামি করা হয়েছে শুধুমাত্র আমার ছোট ভাইয়ের করা মানবপাচার মামলাটি তুলে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে। আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই।’

ভুক্তভোগী জুয়েল বেপারী বলেন, ‘রুবেল বেপারী আমার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে লিবিয়ায় মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখান থেকে ফেরার পর তাকে আমি মামলা করি। আর এখন তারা আমার ভাইদের অন্য একটি হত্যা মামলায় আসামি করে আমাদের ভয় দেখাচ্ছে। আমি এলাকাবাসী ও প্রশাসনের কাছে সুবিচার চাই।’

স্থানীয় লাহেন ফকির বলেন, ‘ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। একজন ভুক্তভোগী মামলা করায় তার ভাইদের বানোয়াট মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এতে জুয়েল ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। আমরা পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আবেদন জানাই, এই পরিবারকে রক্ষা করা হোক।’

মানবপাচার মামলার প্রধান আসামি রুবেল বেপারী পলাতক থাকায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তার বাড়িতে তালা ঝুলছে, মোবাইলেও একাদিক বার ক্ষুদে বার্তা পাঠিও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন খান বলেন, ‘নূর ইসলাম মোল্লার নামে একটি মামলা হয়েছে, যেখানে ৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে অভিযোগ এসেছে যে, অন্তত দুইজনকে সাজানোভাবে আসামি করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। নির্দোষ কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না।’

মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার চাতক চাকরা বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। তদন্তে নির্দোষরা বাদ যাবে এবং কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না।’