ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারালেন ইরানের এক উদীয়মান কবি ও তাঁর পরিবার

১৭ জুন ২০২৫ - ০৮:২৯ পূর্বাহ্ণ
 0
ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারালেন ইরানের এক উদীয়মান কবি ও তাঁর পরিবার

আর মাত্র ১০ দিন পরই ছিল পারনিয়া আব্বাসির ২৪তম জন্মদিন। হয়তো সেই দিনটিকে ঘিরে নিজের জন্য রেখেছিলেন কোনো বিশেষ পরিকল্পনা—কবিতার খাতায় উঠে আসত আরেকটি দারুণ সৃজন। কিন্তু সে সবই এখন অতীত। গোলাপি রঙের এক ম্যাট্রেসে রক্তের দাগ আর ভাঙা কংক্রিটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসা কয়েক গোছা চুল এখন পারনিয়ার পরিচায়ক।

নিজের লেখা শেষ কবিতাটিতে তিনি লিখেছিলেন—
"আমি পুড়ে যাই,
আমি বিবর্ণ হয়ে যাই,
আমি এক নীরব তারা হয়ে উঠি,
যে তোমার আকাশে ধোঁয়া হয়ে যায়..."

মাত্র ২৩ বছর বয়সেই সেই "নীরব তারা"য় পরিণত হলেন পারনিয়া। গত শুক্রবার ভোররাতে তেহরানের কেন্দ্রস্থলে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তাঁর পুরো পরিবার প্রাণ হারায়।

সকালে পারনিয়ার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মরিয়মের। কণ্ঠে কান্না চেপে রেখে তিনি বলেন, “পারনিয়া ছিলেন একাধারে কবি, শিক্ষক এবং আদর্শ কন্যা। কিছুদিন আগে তিনি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। কিন্তু তেহরানে অবস্থিত ইরানের মেল্লি ব্যাংকের কেন্দ্রীয় শাখায় চাকরি ধরে রাখতে ভর্তি প্রক্রিয়া স্থগিত রেখেছিলেন।”

পারনিয়া ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, অনুপ্রাণিত ও স্বপ্নময় একজন তরুণী। তিনি ঘাজভিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুবাদ বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

তবে একটি ক্ষেপণাস্ত্র এসে শেষ করে দিলো সবকিছু। ওইদিন সকালে ইসরায়েল ছোড়া একটি মিসাইল তেহরানের সাত্তারখান এলাকার অর্কিড কমপ্লেক্সে তাঁদের অ্যাপার্টমেন্টে আঘাত হানে। যে মুহূর্তে ক্ষেপণাস্ত্রটি ভবনে আছড়ে পড়ে, পারনিয়া সম্ভবত ঘুমের ঘোরে কোনো স্বপ্ন দেখছিলেন—কিন্তু সেই স্বপ্ন চিরতরে থেমে যায় আগুনের লেলিহান শিখায়।

মরিয়ম জানান, ক্ষেপণাস্ত্রটি ভবনের কেন্দ্রস্থলে আঘাত হানায় পুরো একটি অংশ ধসে পড়ে এবং বহু বাসিন্দা সেখানে প্রাণ হারান। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ছবিতে দেখা যায়—ধ্বংসস্তূপে রক্তাক্ত একটি গোলাপি ম্যাট্রেস, তার ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলের গোছা, যেন কোনো ঘুমন্ত প্রাণ ঘুমিয়ে আছে ধ্বংসের চাদরে।

উদ্ধারকর্মীরা প্রথমে পারনিয়ার মৃতদেহ বের করে আনেন। এরপর পাওয়া যায় তাঁর ছোট ভাই পারহামের নিথর দেহ—মাত্র ১৬ বছর বয়সেই থেমে যায় তাঁর জীবন। কিছুক্ষণ পর কংক্রিটের নিচ থেকে বের করে আনা হয় তাঁদের মা-বাবার মরদেহ, যাঁদের একজন ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, অন্যজন ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা।

ভবনের চতুর্থ ব্লকে ছিল ১০টি ইউনিট। হামলার পর তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলা পুরোপুরি ধসে পড়ে। মরিয়ম বলেন, “মনে হচ্ছিল সেই ফ্লোরগুলো যেন পুরো উধাও হয়ে গেছে।”

এখন সেখানে পড়ে আছে শুধু কিছু স্মৃতি—চুলের গোছা, রক্তাক্ত বিছানা আর সেই কবিতার চরণগুলো, যেগুলোর ভাষা যেন ভবিষ্যতের আগুন ছুঁয়ে গিয়েছিল অজান্তেই।

পারনিয়ার মৃত্যু শুধুই একটি যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা নয়। এটা এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, অসমাপ্ত কবিতার হারিয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা এবং এমন কিছু জীবনের গল্প, যেগুলোর শেষ হতো না কখনো এমন ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে।