ট্রাম্পের শুল্কারোপ সামাল দিতে ১৯ দিনে কী করবে ভারত?

ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে তেল ক্রয়ের ফলে শান্তি স্বরূপ ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। এতে করে ব্যাপক চাপে পড়েছে নয়াদিল্লি। যদিও আগামী ২৭ আগস্ট থেকে নতুন এই শুল্ক কার্যকর হবে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৯ দিন সময় পাচ্ছেন মোদি।
যদিও ভারত ট্রাম্পের শুল্ক আরোপকে ‘অন্যায় ও অযৌক্তিক’ বলে বর্ণনা করেছে ভারত। বর্তমান নয়াদিল্লি বছরে প্রায় ৮৭ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ পণ্য আমেরিকায় রপ্তানি করে। এক্ষেত্রে ট্যারিফের এই হার বজায় থাকলে তার প্রায় পুরোটাই বাণিজ্যিকভাবে ‘আনভায়াবেল’ হয়ে পড়বে। অর্থাৎ অন্য দেশের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ভারত টিকে থাকতে পারবে না।
ভারতের অধিকাংশ রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, তাদের পক্ষে বড়জোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শুল্কবৃদ্ধি মেনে নেয়া সম্ভব। ৫০ শতাংশ শুল্কের ধাক্কা সামলানো তাদের জন্য কার্যত অসম্ভব এবং পথে বসার সামিল।
রপ্তানিতে যে ধরনের প্রভাব পড়বে
জাপানি ব্রোকারেজ ফার্ম নোমুরা এক নোটে উল্লেখ করেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আসলে ভারতের বিরুদ্ধে একটি ‘বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা’র (ট্রেড এমবার্গো) মতো বিষয়। যা বহু ভারতীয় পণ্যের রপ্তানি একেবারে রাতারাতি বন্ধ করে দেবে। কারণ ভারতের প্রধান রপ্তানিকারক বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের মোট রপ্তানির ১৮ শতাংশই যায় মার্কিন মুলুকে, ভারতের মোট জিডিপি-র ২.২ শতাংশ আসে আমেরিকার বাজার থেকে।
ভারতের ইলেকট্রনিকস ও ফার্মা রপ্তানিকে অবশ্য আপাতত অতিরিক্ত শুল্কের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।
তামিলনাডুর তিরুপুরে তৈরি পোশাক কারখানায়, কিংবা গুজরাটের সুরাটে হীরের গয়না বা স্বর্ণালঙ্কারের কারখানায় বহু শ্রমিক হয়তো কাজ হারাবেন, অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানই মুখ থুবড়ে পড়বে।
কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির রাকেশ মেহরাও স্বীকার করছেন, মার্কিন বাজারে ভারতীয় টেক্সটাইলের যে ‘কম্পিটিটিভনেস’ ছিল, সেটাই এবার অন্য প্রতিযোগী দেশগুলোর কাছে তারা খোয়াতে বসেছেন!
এমন পরিস্থিতির মধ্যে অবধারিত বাণিজ্যিক বিপর্যয় সামলানোর জন্য ভারতের হাতে আদৌ কি কোনো উপায় আছে?
রাকেশ মেহরাও বলেন, ‘আমি মনে করি রাশিয়া, চীন ও অন্য আরও অনেক দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর হতে চলেছে।’
তাৎপর্যপূর্ণভাবে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সামনেই চীনে অনুষ্ঠিতব্য সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে চলেছেন। ২০২০ সালে গালওয়ান ভ্যালিতে চীনা ও ভারতীয় সেনার মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর এই প্রথমবার।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের অনেকে ধারণা করছেন, এই সম্মেলন থেকেই রাশিয়া-ভারত-চীন একটি ত্রিপাক্ষিক আলোচনা বা অ্যাক্সিসের (অক্ষ) সূচনা হতে পারে।
দিল্লিতে পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ তথা দক্ষিণপন্থি চিন্তাবিদ শুভ্রকমল দত্ত বিশ্বাস করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘ঔদ্ধত্য’ আর ‘বুলিইং’ এই নতুন অক্ষ তৈরির পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ট্রাম্পের সমস্যা তো শুধু ভারতের সাথে নয়, দেখা যাচ্ছে কানাডা, নেটো, চীন, ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা, আসিয়ান বা মধ্যপ্রাচ্য – সবাইকে ভয় দেখিয়ে তিনি নিজের পথে আনতে চেষ্টা করেছেন।’ তবে বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার এই ধরনের বুলিইং হয়তো কাজে আসতো, কিন্তু এই একুশ শতক একটা নতুন শতক, যেখানে গ্লোবাল অর্ডারটাই আলাদা–এখন আর ওভাবে ভয় দেখিয়ে কোনো কাজ হবে না!
আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা, পাল্টা ট্যারিফ?
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ ট্যারিফ ঘোষণা করেছেন ঠিকই, কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা কিন্তু এখনও বন্ধ হয়ে যায়নি।
এই পরিস্থিতিতে চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য এ মাসের শেষ দিকেই একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল ভারত সফরে আসছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চুক্তির সম্ভাবনা জিইয়ে তুলতে হলে ভারতকে সেখানে ‘খুব কুশলী কূটনীতি’র পরিচয় দিতে হবে।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর উর্জিত প্যাটেল একটি লিংকডইন পোস্টে লিখেছেন, ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ঘোষণায় ভারত এতদিন ধরে ‘যে মারাত্মক ভয়টা পাচ্ছিল, সেটাই সত্যি হয়েছে’।
তিনি বলেন, চলতি মাসের শেষে হতে যাওয়া এই আলোচনা ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি এমন একটি বাণিজ্য যুদ্ধের দিকে যাবে, যার পরিণতি আন্দাজ করাও এখন খুব কঠিন।
এর আগের দফার আলোচনা থমকে গিয়েছিল মূলত ভারতের কৃষি ও ডেইরি খাতে আমেরিকার অধিকতর প্রবেশাধিকারের দাবিকে কেন্দ্র করে, যা দিতে ভারত কিছুতেই রাজি হয়নি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণার পরও প্রধানমন্ত্রী মোদি জানিয়েছেন, তিনি ভারতের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে কোনও আপস করবেন না এবং বিশেষ করে দেশের কৃষকদের পাশে সব সময় থাকবেন।
পরবর্তী আলোচনায় ভারত ডেইরি ও কৃষিখাতে আমেরিকাকে কোনো ছাড় দেয় কি না, সেটাই এখন দেখার।