শতকোটি টাকার সম্পত্তি আ.লীগ নেতা দুই ভাইয়ের কবজায়

গাজীপুরে সরকারি শতকোটি টাকার সম্পত্তি দখলের অভিযোগ উঠেছে সহোদর আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে জাল নথিপত্র তৈরি করে গত ১৫ বছর ধরে নিজেদের কবজায় বিশাল এই সম্পত্তি দখলে রেখেছেন তারা। প্রশাসন বলছে, আগে কী হয়েছে জানি না, তবে এখন কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
জানা গেছে, শ্রীপুর উপজেলার প্রায় ১০০ কোটি টাকার সরকারি জমি হাতিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন ও তার ছোট ভাই তোফাজ্জল হোসেন। তাদের বাড়ি শ্রীপুর উপজেলার মুলাইদ গ্রামে। তাদের বাবার নাম ছব্বত আলী। তোফাজ্জল তেলিহাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও মোফাজ্জল উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা।
এদিকে এই দুই নেতার কাছে বাবা-দাদার কবরস্থানও দখলের শঙ্কায় ভারাক্রান্ত ৯২ বছর বয়সী সালেহা বেগমের। মালিকানার সব নথিপত্র থাকার পরও পেশিশক্তির কাছে বারবার হেরে গেছেন, জমি রক্ষায় প্রতিবাদ করে বারবার মামলা আর পুলিশি হয়রানিতে দিন কাটছে এই বৃদ্ধার পুরো পরিবার।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সালেহা বেগম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও টাকার কারণে এখনো প্রশাসন তাদের পক্ষে কথা বলে। পুলিশ আমাদের হুমকি-ধমকি দেয়।’

জানা গেছে, কিছু অসাধু সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় কাগজপত্রেও জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের নামে নামজারি ও জমাভাগও করে নিয়েছেন। ভূমি অফিসে অনুসন্ধান করে জানা যায়, গাজীপুর মৌজার ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত এসএ ১১৫ আর ৭৬৩৫, ৭৬০৫, ৭৬১০, ৭৬১১, ৭৬১২, ৭৬১৭, ৭৬১৮, ৭৬২৯, ৭৬৩০, ৭৬৩১, ৭৬৩২, ৭৬৩৮, ৭৬৭২, ৭৬৩৩, ৭৬৩৪, ৭৬৩৬, ৭৬৩৭ দাগের ৯ একর স্থানীয় মাপে ২৭ বিঘা জমি শুধু দখল নিয়েই শেষ করেনি তারা, উল্টো জালিয়াতি করে নিজেদের নামে নামজারি করেও নেন। যার নামজারি জমাভাগ নথি নং ৪২৮০/১১-১২ জোত নং ১৮১। বিভিন্ন ভুয়া দলিল তৈরি করে তারা নামজারি জমাভাগ করার অভিযোগ থাকায় এ নথির সূত্র ধরে উপজেলা ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই নথিতে তারা ৭টি দলিল জমা দিয়েছিলেন। সে দলিলগুলো সংগ্রহের পর প্রতিবেদক নিজেই তিনটি দলিল ২৩৪৬/১৯৭৯, ৩৬০৪/১৯৭৮, ৯২৪৪/১৯৬৮নং দলিলের নকলের কপি গাজীপুর রেকর্ডরুম থেকে উত্তোলন করার পর নামজারির নথির সঙ্গে কোনো মিল পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি এ জমি ব্যক্তিদের নামে নামজারির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল ভূমি অফিসের বেশ কিছু কর্মকর্তা। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নথি তৈরি, সরকারি রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধকরণসহ রেকর্ডপত্র পরিবর্তন করেন। এদের সহযোগিতায় তারা ১১-১২ অর্থবছরে এ সরকারি জমি নিজেদের নামে নামজারি জমাভাগ করে নেন।
এখানেই শেষ নয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট মাওনা চৌরাস্তা। ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম স্থান বিবেচনায় এ জমির দাম স্বর্ণের দামের প্রায় সমান। আওয়ামী লীগ নেতা দুই ভাই এখানেও প্রায় ৫০ কোটি টাকার মূল্যের ২২ শতাংশ সরকারি ১নং খাস খতিয়ানের জমিতে দখল নিয়ে গড়ে তুলেছেন সব্বত আলী কাঁচা বাজার। যেখান থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তারা অগ্রিম গ্রহণ করেছেন কয়েক কোটি টাকা ও প্রতি মাসে ভাড়া আদায় করেন প্রায় ১৫ লাখ টাকা।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটি খাস খতিয়ানভুক্ত এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের জায়গা। কয়েকদিন পরপর অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হলেও এক দিন পরই আবার সব আগের মতো হয়ে যায়।
শুধু সরকারি জমি দখল করেই ক্ষান্ত হননি আওয়ামী লীগের এই দুই নেতা। তারা মুলাইদ আনোয়ারা নিট কম্পোজিট সংলগ্ন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সংযুক্ত হওয়া একটি গো-হালটের সিংহভাগ অংশ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়াও স্থানীয় বেশ কয়েকটি পরিবারের পৈতৃক সম্পত্তি ও কবরস্থান জবরদখল করে নিয়েছেন তারা। প্রতিবাদ করলেই মামলা ও পুলিশি হয়রানি করা হয় বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
এ দুই ভাইয়ের মূল নেশা হলো জমির দখল নেওয়া। এ জন্যই তারা বিভিন্ন জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে দখল করেছেন বহু জমি। যার মধ্যে সিংহভাগই হচ্ছে সরকারি জমি। এছাড়াও বিভিন্ন মানুষের জমিও তারা দখল করেছেন আওয়ামী লীগের ক্ষমতার প্রভাবে। গত ১৫ বছর ধরে তারা ছিলেন অনেক বেপরোয়া। এলাকায় তাদের ভয়ে কেউ টুঁ-শব্দও করতে পারত না। প্রতিবাদ করলে শুরু করত মামলা দিয়ে হয়রানি।
অভিযুক্ত মোফাজ্জল হোসেন ৫ জুলাই আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলায় কারাগারে এবং তোফাজ্জল হোসেন পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এদিকে ম্যানেজার সবুজ মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি পরে দেখা করবেন বলে ফোন কেটে দেন। পরে আর তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যারিস্টার সজিব আহমেদ ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন, ‘আগে কে কী করেছে, সেটা জানি না। তবে এখন আর কেউ ছাড় পাবে না।’